রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে রসিকতায় ফার্স্ট লেডিই ফার্স্ট!

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও তাঁর স্ত্রী রাশিদা খানম
ছবি: সংগৃহীত

রসিকতা রহস্যময় জিনিস। এই জিনিসের স্বভাবধর্ম হলো কাউকে না কাউকে খোঁচা মারা। একজন বলবে, আরেকজন চটে যাবে এবং দশজন হাসবে—এই হলো বেশির ভাগ রসিকতার রসাত্মক রসায়ন। যে ওষুধ মারতে পারে না, সে ওষুধ বাঁচাতেও পারে না—অ্যালোপ্যাথি–জগতে প্রচলিত এই বচনের মতো সত্য হলো, ‘রসের বস্ হলো খোঁচা।’ যে রসিকতায় খোঁচা নেই, সে রসিকতায় রসও নেই।

কিন্তু রসিকতাসংক্রান্ত আমার এই নিজস্ব তত্ত্বকে কারও কারও কাছে হাস্যকর ঠেকতে পারে। কারণ, ৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার বঙ্গভবনের দরবার হলে একজন বলেছেন, যথারীতি দশজন হেসেছেন; কিন্তু যাঁকে নিয়ে বলা হলো, হাসা হলো, তিনি মোটেও চটেননি। কিংবা বলা যায়, চটার ‘ক্ষমতার অভাবে’ চটে যাওয়ার বদলে মুচকি মুচকি না হেসে তাঁর উপায় ছিল না।

আপাতদৃষ্টে ‘চটার ক্ষমতার অভাবে অভাবগ্রস্ত’ ব্যক্তিটি হলেন খোদ মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। খোঁচা মারা বক্তা হলেন, ফার্স্ট লেডি রাশিদা খানম। আর যাঁরা হাসলেন, তাঁদের মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছিলেন।

দরবার হলে ওই দিন রাষ্ট্রপতির আত্মজীবনীমূলক ‘আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি’ এবং ভিন্ন অনুষ্ঠানে দেওয়া তাঁর ভাষণের সংকলন ‘স্বপ্ন জয়ের ইচ্ছা’ শিরোনামের বইয়ের প্রকাশনা উৎসব চলছিল।

‘তোমার সংসারে এসে আমার হাড়মাস কালি কালি হয়ে গেল! আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে বুঝতে! একেবারে বাপের নাম ভুলিয়ে দিত’—এই চিরসবুজ সংলাপটি নিখিলবঙ্গের তাবৎ অন্তঃপুরে অনাদিকাল থেকে যাঁরা সংগ্রামমুখরতায় উচ্চকিত রেখেছেন, সেই অন্দরমহলাধিশ্বরীদের প্রতিনিধি হিসেবে ফার্স্ট লেডি রাশিদা খানমকে আবদুল হামিদের সঙ্গে বিগত ছয় ছয়টি দশক কাটাতে হয়েছে। লেখা বাহুল্য, এখনো কাটাতে হচ্ছে। সেই সুবাদে এই আত্মজীবনীর তথ্যগুলো সত্য নাকি মিথ্যা, তা যাচাইয়ে তাঁর মূল্যায়নকে ঠেলে ফেলার সুযোগ নেই। তাই, তাঁর মূল্যায়নের মধ্যে অবমূল্যায়নের আভাস আছে কি না, সেই দিকে সবার নজর ছিল বেশি।

অনুষ্ঠানে রাশিদা খানম বলেছেন, ‘ “আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি” বইয়ের অনেক ঘটনারই প্রত্যক্ষদর্শী আমি। বিশেষ করে কলেজজীবন থেকে ’৭১–এর সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতি আজও আমাকে নাড়া দেয়।’

সাবেক স্পিকার এবং দুইবারের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সম্পর্কে রাশিদা খানম বলেছেন, ‘সুদীর্ঘ ৬০ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি এ পর্যন্ত যতগুলো সিগারেট পুড়িয়েছেন, প্রতিটির বিনিময়ে একটি লাইন লিখলে একটা মহাকাব্য হয়ে যেত।’

তবে বইয়ের অন্য সব ঘটনা ও কাহিনিকে ঠিক বলে সত্যায়ন করলেও প্রেম-বিয়েসংক্রান্ত অংশের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের বিষয়ে তিনি পাঠককুলকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সব ঘটনা ও কাহিনি ঠিকঠাক থাকলেও প্রেম-বিয়ের ঘটনার বর্ণনায় কিছু গন্ডগোল আছে। অর্থাৎ, সুবিধামতো কিছু বাড়িয়ে বলা, আবার কিছু ক্ষেত্রে চেপে যাওয়া, এটা মনে হয় সব পুরুষ মানুষরাই করে থাকে। এ বিষয়ে আপনারা সবটুকু বিশ্বাস করবেন না।’

‘এটা মনে হয় সব পুরুষ মানুষরাই করে থাকে’—এই কথাটির মধ্যে তাবৎ পুরুষকুলের প্রতি ফার্স্ট লেডির সরল মনের সরলীকৃত যে স্পষ্ট খোঁচা আছে, তাকে সিরিয়াসভাবে নেওয়া ঠিক হবে না; কারণ পরিহাস–জগতে বাছবিচার চলে না। পরিহাস–জগতে দুনিয়ার সব স্ত্রীই কলহপ্রিয়, অফিসের সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই অবিবেচক, সব পুলিশই ঘুষখোর।

সাবেক স্পিকার এবং দুইবারের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সম্পর্কে রাশিদা খানম বলেছেন, ‘সুদীর্ঘ ৬০ বছর ধরে তাঁর সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি এ পর্যন্ত যতগুলো সিগারেট পুড়িয়েছেন, প্রতিটির বিনিময়ে একটি লাইন লিখলে একটা মহাকাব্য হয়ে যেত।’

অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন, তামাকের প্রসার রোধে একজন মানুষ কতটা নিবেদিতপ্রাণ হলে দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে সিগারেট নামক প্রাণঘাতী বস্তুকে পুড়িয়ে শেষ করার চেষ্টায় অনড় থাকতে পারেন, তা ফার্স্ট লেডির বক্তব্যে উঠে এসেছে। তবে বিষয়টিকে এভাবে ভাবতে না পারা এবং বক্তব্যেটির দার্শনিক উচ্চতার দিকে নজর দিতে ভুলে যাওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারসহ দরবার হলে উপস্থিত অতিথিরা প্রবল হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি নিজেও!

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের লেখা দুটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী।
ছবি: সংগৃহীত

‘রাষ্ট্রপতি’ একটি অতিমাত্রায় রাশভারী পদ এবং সেই পদে বসার পর প্রকাশ্যে রসিকতা করা অলিখিত ট্যাবু হিসেবে আমাদের ‘টোটেমে’ খুঁটোর মতো গেড়ে বসেছিল। আবদুল হামিদ তাঁর দুই মেয়াদে সেই খুঁটো তুলে ফেলতে পেরেছেন। বিশেষত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাবর্তনে তিনি যেসব ভাষণ (লিখিত ভাষণের বাইরে) দিয়েছেন, সেগুলোকে প্রচলিত সংজ্ঞায় ভাষণ বলা কঠিন। সেসব ভাষণে ফার্স্ট লেডিকে খোঁচা কম মারেননি। বঙ্গভবনের অন্তঃপুরে তাঁর ক্ষমতা কতটা অকার্যকর ও অবদমিত, তার ফিরিস্তি ও অভিযোগ তিনি রাখঢাক না করেই ছাত্রছাত্রীদের কাছে পেশ করেছেন। ছাত্রছাত্রীরা সেসব অভিযোগের সমাধান দেওয়ার বদলে, তা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। সেসব খোঁচা হয়তো ফার্স্ট লেডি জমা করে রেখেছিলেন। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে তিনি ‘পাল্টা মার’ দিয়েছেন।

অনুষ্ঠানে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রসিকতায় কম যাননি। রাষ্ট্রপতির দীর্ঘ আত্মজীবনীর সুদীর্ঘ সংগ্রামমুখর ঘটনাপ্রবাহের মধ্য থেকে বেছে বেছে তাঁর আম চুরির ঘটনাকেই সামনে এনেছেন। বইটি নিয়ে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তিনি (রাষ্ট্রপতি) যে ছাত্রজীবনে গাছে চড়ে বস্তা ভরে আম চুরি করেছিলেন, সেই কথাটা কিন্তু আছে। কারণ, যে বাড়ির আম চুরি, সেই বাড়ির.... ’ এই পর্যন্ত বলে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির অনুসমর্থন চেয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বলব?’ রাষ্ট্রপতি অনুমোদনসূচক ঘাড় নাড়ানোর পর প্রধানমন্ত্রী বলতে থাকেন, ‘সেই বাড়ির কেউ একজন তার প্রতি একটা কটাক্ষ করেছিল। অবশ্য তিনি মানে.... একজন মেয়ের কথাই বলব। তো, সেই কটাক্ষ করার ফলে তিনি প্রতিশোধমূলক...তিনি গিয়ে সেই বাড়ির আম পেড়ে নিয়ে আসেন। তাঁর এই হাস্যরসে ভরা আত্মজীবনীটা পড়লে অনেক মজার মজার কাহিনি পাওয়া যাবে।’

লোকে ছোটবেলা কোঁচড় ভরে আম চুরি করে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখে রাষ্ট্রপতির ‘বস্তা ভরে’ আম চুরির ঘটনা নেলসন ম্যান্ডেলার শৈশবে প্রতিবেশীর খোঁয়াড় থেকে শুয়োর চুরি করে (‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’—নেলসন ম্যান্ডেলা, দ্রষ্টব্য) ঝলসে মাংস খাওয়ার ঘটনাকে মনে করিয়ে দেয়। পাশাপাশি বাঙালির আম ও ছালা হারানো সংক্রান্ত যাবতীয় বিস্মৃতপ্রায় ঘটনাকেও তা ফের সামনে নিয়ে আসে।

রসিকতা তুলোর মতো। তুলো এমনিতে হালকা। কিন্তু পানিতে ডোবালে ভারী হয়ে যায়। অমর্যাদার পানি লাগলে তুলোর মতো লঘু রসিকতাও গুরুতর হয়।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আর ফার্স্ট লেডি রাশিদা খানমের রসিকতা তুলো বরাবর থাকুক।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

[email protected]