ভুভুজেলার অত্যাচার কীভাবে বিনোদন হতে পারে

বিশ্বকাপের আনন্দে ভয়াবহ দূষণ তৈরির যন্ত্র যখন ভুভুজেলা
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে আইনের অভাব নেই। ১৯৮৪ সালের অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন আছে। এই আইনমতে, ১০০ জনের বেশি অতিথি দাওয়াত দিলে অতিরিক্ত অতিথির ওপর জনপ্রতি ২৫ টাকা হারে শুল্ক দিতে হবে। এক লাখ জনে একজন এই আইনের কথা জানেন কি না, সন্দেহ আছে।

বদ্ধ টবে পানি রেখে ‘মশক চাষে’ সহায়তা করলে জরিমানার অধ্যাদেশের কথাও শুনেছি বছর দেড়-দুয়েক আগে। ২০০৬ সালের শ্রম আইন মোতাবেক, রাস্তায় পানের পিক ফেলা, পিকদানি ব্যবহার না করা, ময়লা বিনের বাইরে ফেলাও আইনত নিষিদ্ধ। প্রতিবেশী বা যে কাউকে কোনো আচরণ দ্বারা উত্ত্যক্ত করলে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই বছর পর্যন্ত জেলে রাখার শাস্তি দিতে পারেন। আবাসিক এলাকায় রিকশার গ্যারেজ, মোটরবাইক গাড়ি মেরামত নিরোধের আইন আছে।

ফুটপাত ব্যবহারে অন্যের অসুবিধার কারণ হলে সাজার আইন আছে। কিন্তু সেখানে বসে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করা যায়, রড-সিমেন্ট স্তূপ করে রাখা যায়। ফল-ফলাদি, শাড়ি-চুড়ি-মনোহারির দোকান হিসেবে ব্যবহার করা যায়। নিষিদ্ধ সময়ে অর্থাৎ, সন্ধ্যা ৭টারও পর যন্ত্রে ইট ভাঙা, মিক্সচারে সিমেন্ট মিক্সিং, পাইলিং করা যায়। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা ছাড়িয়ে ৫০০ মিটার দূরে গিয়ে নির্মাণকাজের মেশিনগুলো ব্যবহার করতে হবে। এসব ২০০৬ সালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় থাকলেও কেউ কিছুই মানে না। বেশির ভাগ লোকই এসব আইন জানেন না।

আরও পড়ুন

এগুলো পুরোনো কথা। সবাই দেখেশুনে অভ্যস্ত। ফুটপাত দখলকারীদের জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়েই জেনেছি, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ক্ষমতাবানদের এবং আইন প্রয়োগকারীদের চাঁদা-টোল দিয়ে তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষমতাবানদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা অনায়াসে মুখস্থ বুলি আওড়ান, ‘গরিব মানুষদের পেটে লাথি মারতে চান? তুলে দিলে কোথায় যাবে, কী খাবে? পরিবার নিয়ে বাঁচবে কীভাবে?’ ভাবেসাবে পারলে চাঁদা দেনেওয়ালাদের দুঃখে কেঁদে ফেলেন!

হাসপাতাল, স্কুল, উপাসনালয়, অফিস এলাকা ও আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেঁপু বাজানো, ক্রিং ক্রিং বেল বাজানো, জোরে শব্দ করা, সশব্দে মাইক বাজানো—সবই আইন নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, এগুলোর আশপাশে ১০০ মিটার ‘নীরব এলাকা’ মানতে হবে।

এসব এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দসীমা ছাড়ানো নিষিদ্ধ। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় রাতে ও দিনে অশাস্তিযোগ্য সর্বোচ্চ শব্দসীমা ৪৫/৫৫ ও ৬০/৭০ ডেসিবেল। ৮৫ ডেসিবেল পেরোলে মানুষ হৃদ্‌যন্ত্র, মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র ও শ্রবণযন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়। ৯০ ডেসিবেল ছাড়ালে বধিরতা রোগ বাড়ে। কিন্তু ঢাকা শহরে শব্দদূষণের গড় মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল।

হাসপাতাল, স্কুল, উপাসনালয়, অফিস এলাকা ও আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেঁপু বাজানো, ক্রিং ক্রিং বেল বাজানো, জোরে শব্দ করা, সশব্দে মাইক বাজানো—সবই আইন নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, এগুলোর আশপাশে ১০০ মিটার ‘নীরব এলাকা’ মানতে হবে।

২.

বায়ুদূষণের পর শব্দদূষণেও ঢাকা শহর বিশ্বের ১ নম্বরে। চলতি বছর মার্চের শেষে দেশের সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল খবরটি। কারণ, গবেষণাটি যার-তার নয়, জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির। সংস্থাটির বৈশ্বিক প্রতিবেদনে তথ্যটি প্রকাশ করা হয়। খবরে আসার পর ভেবেছিলাম রাষ্ট্রপক্ষ এবং নগর কর্তৃপক্ষ শব্দদূষণ ঠেকাতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিয়ে এক্ষুনি মাঠে নামবে।

পৃথিবীর যেকোনো দায়িত্বশীল দেশের বা নগর কর্তৃপক্ষেরই তেমনটি করার কথা। জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা না থাকার কারণেই সম্ভবত আমাদের কর্তৃপক্ষ কোনো হেলদোল দেখায়নি। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণকারীদের কর্মস্থল সচিবালয়ও শব্দদূষণের শিকার। প্রথম আলো জানিয়েছিল সচিবালয়-সংলগ্ন জিরো পয়েন্ট মোড়ে একটি সাউন্ড প্রেশার লেভেল (এসপিএল) মিটার বসালে ১২৮ দশমিক ৬ ডেসিবেল মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া যায়। অথচ শব্দদূষণবিধি অনুযায়ী, সচিবালয় ‘নীরব এলাকা’, যেখানে গ্রহণযোগ্য শব্দমাত্রা ৫০ ডেসিবেলমাত্র। তাহলে শব্দদূষণ আইনের প্রয়োগ কীভাবে হবে?

আরও পড়ুন

মাস চারেক আগের কথা। রাত ২টার সময়ও ঘুমানোর জো ছিল না। কাছেই একটি  ছয়তলা দালানের ছাদে গায়েহলুদের ডিজে পার্টি চলছিল। কয়েকটি শক্তিশালী স্পিকারের শব্দ কয়েক কিলোমিটার দূরে ছড়িয়ে পড়ছিল। রাত ৯টা থেকেই যন্ত্রণা শুরু হওয়ার পর ভাবলাম পুলিশে জানানো দরকার। নিচে নেমে দোকানিদের কাছ থেকে জানলাম, পুলিশ কিছুই করবে না। উল্টো সাবধান করলে অহেতুক আমিই বিপদে পড়ব। কারণ, অনুষ্ঠানটি এলাকার এক প্রভাবশালী ছাত্রনেতার বিয়েসংক্রান্ত। গত বছর দুয়েক নিত্যই নানা ছাদ থেকে খোলা ডিজে পার্টির শব্দের উৎপাত সয়ে চলছেন বহু এলাকার মানুষ। যাকেই জিজ্ঞাসা করি, দেখি সবাই হতাশ ও ভুক্তভোগী।

কিন্তু ভয়ে কেউই কিছু বলতে চান না। ঝামেলার নাকি দশ হাত এবং হাতগুলোও নাকি লম্বা এবং ক্ষতিকর। পয়লা বৈশাখ, পবিত্র শবে বরাত, শবে কদরে কিশোর-কিশোরীদের পটকাবাজি ফোটানোকে একধরনের আদুরে আশকারা দেওয়া দেখতাম। এখন উপলক্ষ ছাড়াই পটকা-বাজি-ফায়ারওয়ার্কসের ব্যবহার রমরমা। কিশোর-কিশোরী ছাড়িয়ে প্রাপ্তবয়স্করাও আছেন এই আপাতনিরীহ অপকর্মে।

৩.

রাস্তায় নামলে গাড়ির যথেচ্ছ হর্ন আর অন্যান্য যানবাহনের যথেচ্ছ যন্ত্রণাদায়ক ভেঁপু বাজানোর চোটে টেকা দায়। অনেকে বলেন, চালকদের এই বদভ্যাস বদলের নয়। কথাটি অসত্য। এই চালকেরাই ক্যান্টনমেন্ট বা সেনাসদস্যদের আবাসিক এলাকায় গাড়ি চালানোর সময় ভেঁপুও বাজান না, নির্ধারিত গতিসীমাও ছাড়িয়ে যান না। অর্থাৎ, আইনের প্রয়োগ খুবই সম্ভব। দরকার নীতিনির্ধারক মহলের সদিচ্ছা। মাইকের যাচ্ছেতাই ব্যবহার শব্দদূষণের আরেক বড় কারণ।

ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা যে দলই জিতুক, তার সমর্থকেরা রাত–বিরাতে ভুভুজেলা বাজিয়ে সৃষ্টি করছে ভয়াবহ শব্দদূষণ
ছবি: প্রথম আলো

৪.

এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে ফিফা বিশ্বকাপ উদ্‌যাপনের আনন্দঋতু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়িয়ে সিদ্ধেশ্বরী, পলাশী, আজিমপুর, কলাবাগান, ধানমন্ডিতে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে ভুভুজেলার উৎকট শব্দ। মোটরবাইক র‍্যালির হংকিং, খোল-করতাল, ঢোল-বাদ্য, বাজি-পটকা, থালাবাটি পেটানো তো আছেই। পাশেই দেশের সবচেয়ে বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। অসুস্থজন, রোগীরা, বয়স্কজন, দুর্বল হৃদ্‌যন্ত্রের মানুষ, শিশু ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ অন্যদের বিনোদন-অত্যাচারের বলি কেন হবেন? অন্যের নিদ্রা হরণের, স্বাভাবিক সুস্থতা হরণের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ কেন মেনে নিতে হবে?

বিশ্বকাপ উদ্‌যাপনের বড় পর্দার আয়োজনের পেছনে সব ছাত্রছাত্রীই হামলে পড়েছেন, এমন তো নয়। বেশির ভাগ দর্শকই বাইরে থেকে আসা। সব হলেই অনেক ছাত্রছাত্রীকেই খেলা চলার মধ্যেও পাঠে বসতে হয়। চাকরিবাকরিসহ নানা রকম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মন দিতে হয়। অনেকের টিউশনির জন্য প্রস্তুতির চাপ থাকে। অথবা টিউশনি সেরে বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে রাস্তার জ্যাম ঠেলে হলে ফিরে আরাধ্য বিশ্রামের জন্য বিছানায় পড়তে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, প্রক্টর অফিস ইত্যাদি এই দক্ষযজ্ঞের অনুমতি দেওয়ার সময় সামান্যও কি নিয়মকানুন তৈরির ধার ধারেনি? প্রথম আলোয় লিখেছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বকাপ উদ্‌যাপন ততটা দোষের নয়, দেশের দরকারে ভবিষ্যতে সবাইকে একসঙ্গে পাওয়ার সম্ভাবনার মতো ইতিবাচক ভাবনাও ভাবা যেতে পারে। প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন ছাত্র লিখেছিলেন, ‘এই লেখাটি লেখার আগে ২-৪ দিন মুহসীন হল, এফ রহমান হলে অবস্থান করে, সাথে টিএসসির পাশে রোকেয়া হল, শামসুন নাহার হলের শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়ে লিখলে লেখার মোটিভ হয়তো ভিন্ন রকম হতো।’

ঠিকই লিখেছেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করি কী করে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি ভুভুজেলা, মোটরবাইক র‍্যালির হংকিং, খোল-করতাল, ঢোল-বাদ্য, বাজি-পটকা বন্ধ না করতে পারে, আইনত জমজমাট বিশ্বকাপ উদ্‌যাপনের আয়োজনের মাধ্যমে অপরধ করছে নিশ্চিত। অপরাধ সংঘটনে সহায়তাও করছে এবং এর দায়ও বিশ্ববিদ্যালয়টির অবশ্যই।

মূল প্রশ্নে ফিরি। অপরাধটি কি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন নয়? বিশ্বকাপের আনন্দ-উল্লাসে ভুভুজেলা, পটকা, হংকিং, উচ্চ স্বরের মিছিল বন্ধ করার বিষয়ে কঠিন শাস্তির বিধানসহ নির্দেশনা বা ঘোষণা আসুক। আনন্দ-উল্লাস এগুলো ছাড়াই যথেষ্ট হওয়া সম্ভব। অন্যদের অসুস্থ করে তোলা সরাসরি অন্যের অধিকার হরণ করে চলা অপরাধ। নির্মল আনন্দ এসব বিকৃতি ও ক্ষতিকর প্রমোদের রাহুগ্রাসমুক্ত হয়ে উঠুক। ভুভুজেলা, মোটরবাইক র‍্যালির হংকিং, খোল-করতাল, ঢোল-বাদ্য, বাজি-পটকা কোনোভাবেই অনুমোদন দেওয়া না হোক! শব্দের অত্যাচার কোনো বিচারেই বিনোদন নয়, বিকৃতি। আইনত অপরাধ।

  • হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।