দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘আইনের শাসনভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’র যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও তাঁর পররাষ্ট্রনীতিই সে ধরনের বিশ্বব্যবস্থার ধারণার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করছে। প্রকৃতপক্ষে, বাইডেনের প্রশাসন তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদের বিষয়ে যে ধরনের নীতিকথা বলে এবং সেটিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে যে পন্থা অবলম্বন করে থাকে, তার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত রয়েছে।
গত অক্টোবরে বাইডেন প্রশাসন উন্নত মাইক্রোচিপ প্রযুক্তিতে চীনা কোম্পানিগুলোর অগ্রযাত্রার রাশ টানতে চীনের মাইক্রোচিপ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। এটি একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ ছিল এবং দৃশ্যত জাতীয় নিরাপত্তার কারণে মাইক্রোচিপ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে এটি একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। বাইডেন প্রশাসন যদিও আমাদের ওপর একটি শীতল যুদ্ধ নেমে এসেছে—এমন ধারণা দূর করতে অনেক চেষ্টা করেছে; কিন্তু তারা যেসব কর্মকাণ্ড করছে, তা সোভিয়েত-মার্কিন শত্রুতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যত দেশের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে, তার বেশির ভাগেরই ভিত্তি হলো বাণিজ্য বিরোধ কিংবা মানবাধিকার ইস্যু কিংবা বৈশ্বিক ঐকমত্যে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করা। চীন এই ধারণাগুলোকে পদদলিত করেছে এবং যথারীতি এখন যুক্তরাষ্ট্র তার নীতি অনুসরণ করছে।
জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাইডেন প্রশাসন আমেরিকান প্রধান জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে এমন সময় ভেনেজুয়েলায় পুনরায় প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে, যখন প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর শাসন ভেনেজুয়েলায় স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। বাইডেনের এ ধরনের দ্বৈত নীতি তাঁর জবানকে হালকা এবং খেলো করে তুলেছে।
চীন কোনো দেশের ওপর ক্ষুব্ধ হলে দেশটি প্রায়শই তার বাণিজ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। যেমন ২০১০ সালে একজন চীনা ভিন্নমতাবলম্বীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার পর চীন নরওয়ে থেকে স্যামন মাছ আমদানি স্থগিত করে। দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও চীন একই ধরনের আচরণ করেছে এবং সম্প্রতি লিথুয়ানিয়া রাজধানী ভিলনিয়াসে তাইওয়ানের প্রতিনিধির অফিস খুলতে দেওয়ায় চীন ক্ষুব্ধ হয়ে লিথুয়ানিয়ার ওপর কয়েক দফা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
শান্তি, সমৃদ্ধি এবং বৃহত্তর বোঝাপড়ার অনুঘটক হিসেবে বাণিজ্যকে ব্যবহার করা অনুকরণীয় মডেল হতে পারে না। আমেরিকার বিষাক্ত ও মেরুকৃত রাজনীতি এবং তার উদার গণতন্ত্রের ত্রুটিগুলোর উপজাতই মূলত রাজনীতিবিদদের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্পর্কিত বক্তব্য ও তাদের কাজের মধ্যে ফারাক তৈরি করেছে।
এর একটি সর্বোত্তম উদাহরণ হলো বাইডেন প্রশাসনের স্বাক্ষরিত শিল্পনীতি উদ্যোগ, যা মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন (আইআরএ) নামে পরিচিত। এই আইনের আওতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোম্পানি এবং বিদ্যুৎ–চালিত যানবাহন নির্মাতা কোম্পানিগুলোকে ‘দেশের অভ্যন্তরে’ বাণিজ্য বাড়াতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ জন্য শত শত কোটি ডলার ভর্তুকি দেওয়া এবং ট্যাক্স কমানোর লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
আইআরএ এখন ইউরোপে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিশিল্পায়ন ঘটানোর হুমকি দিচ্ছে এবং তা ইইউয়ের কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
এই অর্থনৈতিক বিচ্যুতি ইউরোপীয় রাজনীতিতে জনতুষ্টিবাদী শক্তির উত্থান ঘটাবে। এর ফলে ওয়াশিংটনের জন্য যখন ইউরোপীয় ঐক্য সবচেয়ে বেশি দরকার, সেই মুহূর্তে জনতুষ্টিবাদের উত্থান ইউরোপীয় ঐক্যকে জটিল করে তুলতে পারে।
মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে এবং অংশত বাইরের দেশে পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নিজের ভাবমূর্তির দূরত্ব দেখানোর জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর পররাষ্ট্রনীতিকে গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রভিত্তিক দেখানোর চেষ্টা করছেন। তবে জো বাইডেনের ক্রিয়াকলাপ তাঁর কথাকে ফাঁপা করে দিয়েছে।
জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাইডেন প্রশাসন আমেরিকান প্রধান জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে এমন সময় ভেনেজুয়েলায় পুনরায় প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে, যখন প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর শাসন ভেনেজুয়েলায় স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছে। বাইডেনের এ ধরনের দ্বৈত নীতি তাঁর জবানকে হালকা এবং খেলো করে তুলেছে।
২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসন ‘গণতন্ত্রের জন্য শীর্ষ সম্মেলন’-এর আয়োজন করেছিল। সে সময় তারা সে সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি। অথচ দেশটি সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের একটি কট্টর (যদিও ত্রুটিপূর্ণ) গণতন্ত্রের দেশ এবং বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশগুলোর একটি।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
জ্ঞানেশ কামাত মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক