চীনের ‘গানবোট কূটনীতিতে’ প্রতিবেশীরা যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই ঝুঁকছে

সি চিন পিং কেন দক্ষিণ চীন সাগরে উপনিবেশ স্থাপন করতে চানছবি : রয়টার্স

মানুষের আশ্রয়হীনতার কথা বলতে গিয়ে এই পৃথিবীতে যে কেউই বলতে পারেন, ‘মৃত্যু আর কর ছাড়া আর কিছুই পৃথিবীতে নিশ্চিত নয়।’ কেউ কেউ বলে থাকেন, আমেরিকান কথাসাহিত্যিক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রথম এই শব্দবন্ধযুক্ত প্রবাদটি প্রথম উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সম্ভবত ১৭১৬ সালে ক্রিস্টোফার বুলকের প্রহসন নাটক প্রেসটনের মুচি-এর ভাঁড় চরিত্র টবি গজলের মুখে প্রথম এই শব্দবন্ধ শোনা গিয়েছিল।

গজলের প্রতি সব শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, যুদ্ধ হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় অনিবার্য বাস্তবতা। বর্তমান বিশ্বে লেবানন, ইউক্রেন ও সুদানের মানুষেরা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। চীনের সম্প্রসারণবাদী শাসকেরা দক্ষিণ চীন সাগরের অশান্ত জলরাশিকে আবার যুদ্ধের পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে। উপকূলীয় দেশ ফিলিপাইন ও জাপানকে বেইজিংয়ের আগ্রাসনের মুখে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সংঘাত এড়ানোর কোনো পথ নেই। সত্যি বলতে কি, সেটা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পশ্চিমা নিরাপত্তা কৌশলের মূল কেন্দ্রে রয়েছে, তাইওয়ানকে চীন দখল করে নেবে এই হুমকি। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র পশ্চিমাদের জন্য আরেকটি মূল উদ্বেগ। দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্ককে প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়, কিন্তু সেটা কোনো অংশেই কম উদ্বেগ নয়।

ঠিক কেন ও কোন উদ্দেশ্য থেকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সুপরিকল্পিতভাবে প্রতিবেশীদের প্ররোচিত করে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেটা এখন পর্যন্ত একটা ধাঁধা। সি চিন পিংয়ের কর্মকাণ্ডগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় মগজহীন সাম্রাজ্যবাদী লর্ড পামারস্টনের ‘গানবোট কূটনীতি’ আজও শেষ হয়নি।

সি চিন পিং কেন দক্ষিণ চীন সাগরে উপনিবেশ স্থাপন করতে চান, তার কারণগুলো অনুধাবন করা কঠিন নয়। চীন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই, ফিলিপাইন ও তাইওয়ানকে ঘিরে থাকা বিস্তীর্ণ যে জলরাশি সেখানটা তেল, গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ এবং মাছে সমৃদ্ধ ভান্ডার। এর বেশির ভাগটাই এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর বিশ্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পথ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে পরাশক্তির দ্বন্দ্ব তীব্র হচ্ছে, সেই বিবেচনায় এই সমুদ্রপথটি চীনের প্রতিরক্ষার জন্য কৌশলগত দিক থেকে প্রধানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে, অন্য দেশগুলোর বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে এবং বিতর্কিত দ্বীপগুলোর ওপর প্রতিদ্বন্দ্বীদের দাবি প্রত্যাখ্যান করে চীন বলে চলেছে, প্রায় পুরো এলাকার ওপর সার্বভৌম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিহাস তাদের পক্ষে রয়েছে।

সম্ভবত সি চিন পিং জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙা করার কৌশল নিয়েছেন, যাতে দেশে তাঁর যে ব্যর্থতা, সেখান থেকে জনগণের মনোযোগ ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চান। সি চিন পিং সম্ভবত এই হিসাব করেছেন, যদি সংঘাতের বিষয়টি সত্যি সত্যি সামনে এসে পড়ে, তাহলে ক্রমাগত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক সংঘাতে তার মিত্র ফিলিপাইন, তাইওয়ান কিংবা অন্য কোনো দেশের পক্ষে এসে লড়াই শুরু করবে না।

২০১২ সালে সি চিন পিং ক্ষমতায় আসার পর থেকে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমাগতভাবে সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে চীনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রদ্রিগো দুতার্তেকে হারিয়ে ফিলিপাইনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পশ্চিমাপন্থী মার্কোস জুনিয়র।

গত জুন মাসে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জের (আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিপাইনের অর্থনৈতিক অঞ্চল) সেকেন্ড টমাস শোলে (বালুর তীর যেটা পানির প্রবাহকে অগভীর করে) চীনের কোস্টগার্ড বাহিনীর সেনারা অস্বাভাবিক একটা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। তারা ফিলিপাইনের নৌকাগুলো আক্রমণ করে এবং সেগুলো ক্ষতিসাধন করে। উন্মত্তের মতো চাকু ও কুঠার নিয়ে হামলা চালায়। সৌভাগ্যক্রমে এই হামলায় কেউ নিহত হননি।

দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে চুক্তি হওয়ার পরও গত মাসে সাবিনা শোলে নোঙর করে রাখা ফিলিপাইনের একটা জাহাজ নিয়ে আবারও সমস্যা তৈরি করে। সাবিনা শোল ফিলিপাইনের উপকূল থেকে মাত্র ৮৬ মাইল দূরে অবস্থিত, অথচ চীনের উপকূল থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৬০০ মাইল।

চীনের এই অব্যাহত উসকানির কারণে ফিলিপাইন তার পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। মার্কোস আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে আঁকড়ে ধরেছে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত একটা যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির যে সুযোগ সেটাকে কাজে লাগিয়ে ভিয়েতনাম, ব্রুনেইসহ ও চীনের গুন্ডামির শিকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করতে ও বাড়াতে তৎপরতা চালাচ্ছে ফিলিপাইন।

চীনের কর্মকাণ্ডের তীক্ষ্ণ সমালোচনা করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন মার্কোস জুনিয়রকে প্রতিশ্রুতি দেন যে দক্ষিণ চীন সাগর ও অন্যখানে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় ফিলিপাইনকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাবে। এসব ঘটনা যে সত্যকে সামনে এনে দিচ্ছে সেটা হলো, আঞ্চলিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ে সম্ভাব্য বৈশ্বিক প্রভাব কতটা বিপজ্জনক মাত্রায় চলে যেতে পারে।

সি চিন পিংয়ের সম্প্রসারণবাদী নীতি অন্য দেশগুলোর ওপরেও একই ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি পূর্ব চীন সাগরের সেনকাকু দ্বীপে চীনের জাহাজ উপস্থিতির প্রতিবাদ জানিয়েছে জাপান। সেনকাকু দ্বীপকে নিজেদের বলে দাবি করে বেইজিং। গত মাসে নজিরবিহীনভাবে একটা গুপ্তচর বিমান জাপানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে।

এসব উসকানির প্রতিক্রিয়ায় জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক মজবুত করেছে। চীন জোর করে তাইওয়ানকে ‘পুনরেকত্রীকরণের’ চেষ্টা জারি রাখায় জাপানের ব্যবসা ও নিরাপত্তায় ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। সি চিন পিং প্রেসিডেন্ট থেকে সরে যাওয়ার আগেই সেটা করে যেতে চান।

১৯৪৫ সালের পর থেকে জাপান যে শান্তিবাদী নীতি বজায় রেখে আসছিল, ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে আসছে। প্রতিরক্ষা খাতে জাপান বাজেট বরাদ্দ বাড়াচ্ছে এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করছে।

দৃষ্টান্ত হিসেবে জাপান তাদের দীর্ঘকালের শত্রুদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করেছে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মিলে নিরাপত্তা সহযোগিতা জোট কোয়াড গঠন করেছে জাপান। ফিলিপাইনের সঙ্গে একটা ‘সমুদ্রসীমাবিষয়ক সংলাপ’ শুরু করেছে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কোয়াড নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। এই বৈঠকে দক্ষিণ চীন সাগরের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্র ছিল।

এই যে, দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় এবং যৌথ প্রতিরক্ষা সংযোগগুলো সম্প্রসারিত ও দৃঢ় হচ্ছে, সে বিষয়টি নিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতিবিদেরা এশিয়ার ন্যাটো ধারণা নিয়ে কথা বলছেন। সি চিন পিং এ ব্যাপারে কী ভাবছেন?

সম্ভবত আজকের দিনের বেইজিংয়ের সম্রাট বিশ্বাস করেন, তার প্রতিবেশী দেশগুলো চীনের রূঢ় জবরদস্তি ও বিশাল অর্থনৈতিক শক্তির কাছে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানাবে। কম্বোডিয়া ও লাওস এরই মধ্যে এ তালিকায় যোগ দিয়েছে।

মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২০টি দেশ কূটনৈতিক পথে সমাধানের জন্য তাদের আশা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। এ মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের এক ফাঁকে এই ২০ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একসঙ্গে বসে সমুদ্রে চীনের মাস্তানির ব্যাপারে আলোচনা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

সম্ভবত সি চিন পিং জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙা করার কৌশল নিয়েছেন, যাতে দেশে তাঁর যে ব্যর্থতা, সেখান থেকে জনগণের মনোযোগ ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চান। সি চিন পিং সম্ভবত এই হিসাব করেছেন, যদি সংঘাতের বিষয়টি সত্যি সত্যি সামনে এসে পড়ে, তাহলে ক্রমাগত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক সংঘাতে তার মিত্র ফিলিপাইন, তাইওয়ান কিংবা অন্য কোনো দেশের পক্ষে এসে লড়াই শুরু করবে না।

সি চিন পিংয়ের এই ধারণা খুব একটা ভুল প্রমাণিত হবে না, যদি নভেম্বরের নির্বাচনে বিচ্ছিন্নতাপন্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

সাধারণভাবে যুদ্ধ ঐতিহাসিক অনিবার্যতা। কিন্তু এখন দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব যদি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বিজয়ী সাম্রাজ্যবাদীর মতো আচরণ করা বন্ধ করে।

  • সিমোন টিসডাল, দ্য গার্ডিয়ানের পররাষ্ট্রবিষয়ক লেখক
    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে