ঢাকা বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ ও ২-এর ভবন নিয়ে প্রবাসীরা তেমন অভিযোগ করেন না, মূলত করেন বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং নিয়ে। অপেশাদার ব্যাগেজ হ্যান্ডেলিং, লাগেজ কাটা ও চুরি, মানহীন চেক–ইন ও চেক–আউট সার্ভিস, ইমিগ্রেশনে অদক্ষ সেবা ও সময়ক্ষেপণ, সোনা ও মাদক চোরাচালান, প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানি ও ঘুষ, জাল ভিসার চক্র, গোয়েন্দা হয়রানি, ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত লাগেজ বহনের চক্র ইত্যাদি বন্দরের নিয়মিত সমস্যা।
তা ছাড়া ইচ্ছা করে প্রবেশ ফটক বন্ধ রেখে এক বা দুটি স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে শত শত যাত্রীকে লম্বা লাইনে রাখা ও টিকেটিং-সংক্রান্ত সেবাও অপ্রতুল। নেই প্রতিযোগিতামূলক কারেন্সি এক্সচেঞ্জ সেবা, মানসম্পন্ন ট্যাক্সি। লাউঞ্জ ছাড়া টয়লেটগুলো ব্যবহার করা মুশকিল। অন্য বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ট্রান্সপোর্ট কানেকটিভিটি। বাস-ট্রেন-মেট্রো দিয়ে নগরের প্রবেশপথের সঙ্গে সিমলেস সংযোগ না থাকা।
ঢাকা বিমানবন্দরে আসা-যাওয়ার জন্য প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে যাত্রীদের ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যবহার করতে হয়, এটা একটা বিমানবন্দরের বড় দুর্বলতা।
২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটারের ফ্লোর স্পেসের (বর্তমানের ২ বা ৩ গুণ) টার্মিনাল-৩-এর ধারণক্ষমতা ১ কোটি ৬০ লাখ যাত্রীর। বর্তমান ৮টির পাশাপাশি নতুন টার্মিনালে মোট বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে ২৬টি। নতুন টার্মিনালে মোট ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে, আগের দুটিতে রাখা যেত ২৯টি উড়োজাহাজ। আগে দুই টার্মিনাল মিলিয়ে ৮টি, তৃতীয় টার্মিনালে বেল্ট আছে ১৬টি। আগে চেক-ইন কাউন্টার ছিল ৬২টি, ইমিগ্রেশন কাউন্টার ছিল ১০৭টি।
তৃতীয় টার্মিনালে আরও যুক্ত হয়েছে চেক-ইন কাউন্টার ১১৫টি আর ইমিগ্রেশন কাউন্টার ১২৮টি। টার্মিনাল-৩ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেলের একটি রুটের সঙ্গে সংযুক্ত। টানেলের মাধ্যমে এটি হজ ক্যাম্প ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সঙ্গেও যুক্ত থাকবে।
নতুন টার্মিনালের মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যার বেশ কিছুর সমাধান হবে আশা রাখি। এই আশার আরেকটা কারণ, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং দায়িত্ব পাচ্ছেন বিদেশিরা। তবে এটা একটা লজ্জাও।
জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ বিদেশিদের হাতে দেওয়ার বিপক্ষে থাকার কথা ছিল আমাদের, কিন্তু অবস্থানটা নেওয়া যাচ্ছে না, দুঃখিত! ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকায় জাপানের মিতসুবিশি, ফুজিটা ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং যৌথভাবে টার্মিনালটির নির্মাণকাজ করছে, ফ্রান্সের সহায়তায় আধুনিক প্রযুক্তির রাডারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় আকাশ নিরাপত্তাব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছে। তবে আর্থিক সহযোগিতাকারীদের চাপেই গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং বিদেশিদের দিতে হচ্ছে বলে আলোচনা আছে।
প্রতি পাঁচ বছরে অন্তত চার বছর বিমান লোকসানে থাকে, লোকসান শত কোটি থেকে হাজার কোটি পর্যায়ে। দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও রাষ্ট্রীয় পতাকা বহনের অজুহাতে ক্রমাগত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। লিজে আনা উড়োজাহাজ, টিকিট বিক্রি ও বুকিং নিয়োগে স্বার্থবিরোধী চুক্তি, চোরাচালান এবং অপারেশন দুর্নীতিতে লোকসান হাজার কোটি টাকা (বণিক বার্তা, ৪ অক্টোবর ২০২০; ডেইলি স্টার, ২০ জুন ২০২৩; প্রথম আলো ২০ এপ্রিল ২০১৪)।
বিমানের রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ আসে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং থেকে, পরিমাণ বছরে সর্বোচ্চ ৮০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। সেবার নিম্নমান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা হওয়ায় বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনা ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব জাপানের প্রতিষ্ঠানকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় দেওয়া হচ্ছে।
বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের একক মনোপলির কারণে দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলোর কোনো উন্নতি করা হয়নি। ৮০০ কোটি টাকার ব্যবসা বাইরে চলে যাবে। এভাবে আমরা সব জায়গায় ব্যর্থতা দেখাচ্ছি। আমাদের গার্মেন্টসের ম্যানেজার থেকে শুরু করে কারিগরি কর্তাও বিদেশ থেকে আসেন। এভাবেই চলছে।
অর্থাৎ এতে বিমানের আয় ব্যাপকভাবে কমবে, যা বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চুরি ও দুর্নীতির খাসলত পরিবর্তন না করার অবধারিত ফল।
বিমানবন্দরগুলোয় গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং সার্ভিস পরিচালনা করতে এয়ার নেভিগেশন অর্ডার (এএনও) সার্টিফিকেট নেই বিমানের। ২০১৮ সালে এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হলেও এএনও সার্টিফিকেশন ছাড়াই অপেশাদার গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং করছে বিমান।
গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং থেকে অর্জিত আয় দিয়ে বিমানের কর্তারা দুর্নীতি ঢাকেন বলে তৃতীয় টার্মিনাল অপারেশনে গেলে বিমানের আয়-ব্যয়ের চিত্র আমূল পাল্টে যাবে। বাংলাদেশ বিমান আরও বেশি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে। স্বাভাবিকভাবেই বিমানকর্তারা সিদ্ধান্তটি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, যাঁরা এত দিনের হালুয়া-রুটির ভাগ পেতেন। যাত্রীরা যাঁরা বিদেশ যান-আসেন, তাঁরাই শুধু জানেন যে কী পরিমাণ অব্যবস্থাপনা গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ে বিদ্যমান। যাঁর লাগেজ কাটা পড়েছে, চুরি হয়েছে, যাঁর ফ্লাইট মিস হয়েছে, তিনিই বোঝেন হয়রানি ও অপব্যবস্থাপনার জ্বালাটা।
টার্মিনাল-৩-এর গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং চলে গেলে বিমানের মাত্র ২১টা ফ্লাইট দিয়ে উল্লেখ করার মতো রাজস্ব আসবে না। বিমান যে নিম্নমানের সেবা দেয়, তাতে বিকল্প পেলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অন্য এয়ারলাইনসগুলো বাংলাদেশ বিমানের গ্রাউন্ড সেবা নেবে না। সরকার বিমান চালাতে বাজেট থেকে হাজার কোটি ভর্তুকি না দিতে পারলে, বিমানকে বেসরকারীকরণ করা অবধারিত হয়ে উঠবে।
বিদেশি কোনো সংস্থা গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব পেলে যেমন দেশের টাকা বিদেশে চলে যাবে, তেমনি বিমানবন্দরের মতো স্পর্শকাতর এলাকায় বিদেশিরা দায়িত্ব পালন করলে নিরাপত্তার বিষয়টিও প্রশ্নের মুখে পড়বে। আবার বিমানবন্দরে দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার হয়রানি ও ঘুষের চক্র নিয়ে বিদেশগামী শ্রমিকদের সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে, তিন থেকে চারটা ভিন্ন ভিন্ন সংস্থার হাত পেরিয়ে প্লেন ধরার অনিশ্চয়তা তাঁদের জন্য বড় ধরনের হয়রানি।
ভারত থেকে যে শ্রমিক সোয়া লাখ টাকার মতো অর্থ খরচ করে মধ্যপ্রাচ্য যেতে পারেন, একই কাজে আমাদের শ্রমিকদের ঢাকা থেকে চার লাখ টাকা লাগে। বন্দরের উচ্চ শুল্ক, টিকিটের উচ্চ মূল্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার বখরা ও ঘুষের চক্র ঢাকা বিমানবন্দরকে অদক্ষ করে রেখেছে। শুধু নতুন ভবনে, দামি মেশিনে এসব সমস্যার সমাধান হবে না, সরকারকে যাত্রীসেবার অপসংস্কৃতি থামাতে বাড়তি নজর দিতে হবে। অভিযোগ আছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিস, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে বিমানবন্দরের রমরমা অবৈধ আয় ভাগাভাগি হয় বলেই সেবা উন্নয়নে ব্যবস্থা আসেনি।
ঢাকা বিমানবন্দরের কারিগরি সমস্যা ছিল নিম্নমানের রানওয়ে, এক বা দুটিমাত্র ট্যাক্সিওয়ে ও সীমিত উড়োজাহাজ পার্কিং। নতুন ভবনে ট্যাক্সি ও পার্কিংয়ের সংখ্যা অনেক বাড়বে। কিন্তু রানওয়ের তাৎপর্যপূর্ণ কোনো উন্নতি হবে না হয়তো, এখানে আছে এয়ার নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্সের সমস্যা।
ঢাকা বিমানবন্দরের চার্জ এশীয় অঞ্চলে প্রায় সর্বোচ্চ বলে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম বেশি। তবে এর একটা পরোক্ষ কারণ আছে, সেটা হচ্ছে আসা ও যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়টা অনেক লম্বা, গ্রাউন্ড সার্ভিস খারাপ বলে এয়ারক্রাফট দ্রুত অফলোড করে আবার যাত্রী লোড করে ফিরে যেতে পারে না। বিমান ল্যান্ডিং করার আগে আকাশে ওয়েটিংয়ে থাকে, অফলোডিং বে দেরিতে আসে, লাগেজ হ্যান্ডেলিং স্লো, চেক-ইন স্লো, ইমিগ্রেশন স্লো, পাশাপাশি ক্লিনিংও পেশাদারির সমস্যা।
অদ্ভুত ও লজ্জাজনক একটি সমস্যা হচ্ছে ভিআইপিরা দেরিতে আসেন। তা ছাড়া জাল ভিসার কারণে কিংবা অপরাধী বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের অফলোড করতে হয় বলে বা ভিআইপি মুভমেন্টে যানজট লেগে থাকার কারণে প্রায়ই উড়োজাহাজ সঠিক সময়ে টেকঅফ করতে পারে না। এই এয়ারটাইমের মূল্য সবার অজান্তেই টিকিটের দামের সঙ্গে যোগ হয়।
ইতিহাদ ঢাকায় যাত্রা বন্ধ করেছে। ট্রাভেল এজেন্টদের কমিশন নিয়ে ক্যারিয়ারগুলোর আপত্তি আছে। ডলার-সংকটে এয়ারলাইনগুলো বাইরে লভ্যাংশ নিতে পারছে না বলে ফ্লাইট কমিয়ে দিচ্ছে, এতে টিকিটের দাম আরও বাড়ছে। কলকাতা থেকে হজ ও ওমরার যাত্রীরা ঢাকার যাত্রীদের চেয়ে অন্তত ৪০ শতাংশ কম ভাড়া দেন; দুবাই, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক—সব গন্তব্যেই ভাড়া অত্যধিক বেশি, সার্ভিস খারাপ। নতুন টার্মিনাল কি এসব সমস্যার সমাধান করতে পারবে?
বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের একক মনোপলির কারণে দুর্নীতির ক্ষেত্রগুলোর কোনো উন্নতি করা হয়নি। ৮০০ কোটি টাকার ব্যবসা বাইরে চলে যাবে। এভাবে আমরা সব জায়গায় ব্যর্থতা দেখাচ্ছি। আমাদের গার্মেন্টসের ম্যানেজার থেকে শুরু করে কারিগরি কর্তাও বিদেশ থেকে আসেন। এভাবেই চলছে।
বলা হচ্ছে, ঢাকা বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ উদ্বোধন করা হলে দেশের পর্যটনে বিদেশিরা আকৃষ্ট হবেন। এমন একপেশে আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে পর্যটন গন্তব্যের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যময়, সাশ্রয়ী কানেকটিভিটি দরকার, দরকার উন্নত পর্যটনসেবা এবং নিরাপত্তা। বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন দেখতে কোনো দেশে বিদেশি পর্যটক আসেন না, দুঃখিত।
ঢাকা এমন এক বিমানবন্দর, যেখানে ট্রলিগুলো দালালের হাতে জিম্মি, ট্রলি নিতে তাঁদের ভাড়া করা লাগে কিংবা ঘুষ দেওয়া লাগে। এমনকি টয়লেটেও থাকে টিস্যু দালাল। হয়রানিমুক্ত চেকইনেও দালাল ভাড়া করা লাগে। নতুন টার্মিনালে এসব সমস্যার সমাধান করা হবে কি?
ঢাকা বিমানবন্দরের টার্মিনাল-৩ দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হিসেবে বিবেচিত থাকবে। এর জন্য আওয়ামী লীগ প্রবাসীদের ধন্যবাদ পাবে। তবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং ওপরে বর্ণিত এসব খাসলত থেকে গেলে বিলিয়ন ডলারের সুন্দর ভবনে মানুষের মন ভরবে না।
বিদেশি কোম্পানি গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব পেলেও সেখানে আমাদের লোকজনই কাজ করবেন। ভয়টা কিন্তু সেখানেই। তাঁদের আচরণগত পরিবর্তন এবং দুর্নীতির মানসিকতা ও চর্চা বন্ধ জরুরি। শুধু ভবন নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানের সেবাদানের সক্ষমতাই মুখ্য।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। ই-মেইল: [email protected]