২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৭টি দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নিকট ইতিহাসে খুব কম ক্ষেত্রেই এই নজির আছে। অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ১০টি খাত লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি, প্রযুক্তি, ভ্রমণ, জাহাজ ও বিমান চলাচল, পণ্য পরিবহনের মতো খাত রয়েছে।
১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেন কুয়েতের বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করলে জাতিসংঘ ইরাকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এতে দেশটির অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। মস্কোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ সে রকম কিছু হয়নি।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের এক বছর পর কয়েকটি বিষয় এখন স্পষ্ট। নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতি এবং এর ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতি ধসিয়েও দিচ্ছে না, ইউক্রেনে যুদ্ধ থামাতেও সহযোগিতা করছে না।
মার্কিন ডলারের আধিপত্যের কারণে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে, এ বিষয়ে অনেক বেশি আলোচনা চলছে। কিন্তু রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে শক্তিশালী পাল্টা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, সেটি এখন সেভাবে আলোচিত হচ্ছে না। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বাণিজ্যের যে বৈচিত্র্যকরণ ঘটছে, তাতে এশিয়ার অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার হয়েছে।
আধুনিক অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞার প্রথম ব্যবহার হতে দেখি বিশ শতকের প্রথম দিকে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সে সময় ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। সময়ের পরিক্রমায় এ শ্রেষ্ঠত্ব যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। শীতল যুদ্ধকালে বিশ্ব অর্থনীতিতে পশ্চিমা আধিপত্য ছিল, সে সময় ব্যাপকভাবে নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ হয়েছিল। কিন্তু এর পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতির ভারকেন্দ্র ধীরে ধীরে পূর্বের দিকে সরে আসতে শুরু করে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে নিম্নমুখী করলে এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য পুনর্বিন্যস্তের মাধ্যমে দেশটি তার অর্থনীতিকে টেকসই রাখতে পেরেছে। চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার অর্থনীতিকে রমরমা করে তুলেছে। এই ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে পশ্চিমা বিশ্ব যদি আরও নিষেধাজ্ঞা দিতে চায়, তাহলে তাদের চিন্তা করতে হবে।
২০২১ সালে এশিয়ার অর্থনীতি ছিল বৈশ্বিক জিডিপির ৩৯ শতাংশ। মহাদেশগত জিডিপির হিসাবে এশিয়া এখন বৃহত্তম। বৈশ্বিক রপ্তানির ৩৬ শতাংশ এখন এশিয়া থেকে হয়। চীন ও হংকং, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারত—এশিয়ার বৃহত্তম পাঁচ অর্থনীতি বৈশ্বিক আমদানির চার ভাগের এক ভাগ করে থাকে।
২০২২ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বিশ্ব অর্থনীতির ভারকেন্দ্রে এশিয়ামুখী হওয়ার প্রবণতাকে আরও স্পষ্ট করে সামনে নিয়ে এসেছে। মস্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের উদ্দেশ্যটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের একজন কর্মকর্তার ভাষ্য থেকে বোঝা যায়। ওই কর্মকর্তা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছিলেন, রাশিয়ার অর্থনীতি ‘আঘাত করে চুরমার’ করে দিতে হবে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে স্বল্প সময়ের জন্য অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও রাশিয়া তাদের ক্ষতিগ্রস্ত বাণিজ্যের বেশির ভাগটাই এশিয়ায় পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা নিষেধাজ্ঞার প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।
এশিয়া এখন রাশিয়ান পণ্যের বিকল্প রপ্তানি গন্তব্য এবং একই সঙ্গে আমদানির নতুন উৎস। চীন, ভারত, তুরস্ক, উপসাগরীয় ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এখন রাশিয়ার অর্থনীতিকে ভাসিয়ে রেখেছে। ২০২২ সালে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৯ শতাংশ বেড়েছে এবং ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে এসে সেটা ৩৯ শতাংশ বেড়েছে।
২০২৩ সালের শেষে চীন ও রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে পৌঁছাতে পারে। অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি অথবা ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, তার থেকে এ অঙ্ক অনেক বড়। ২০২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য ৬৮ শতাংশ, তুরস্কের সঙ্গে ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। ভারত-রাশিয়ার বাণিজ্য বেড়েছে ২০৫ শতাংশ।
জ্বালানি রপ্তানির বাজার বিচিত্রমুখী করায় সেটা রাশিয়ার জন্য জীবনদায়ী হয়েছে। জ্বালানি রাশিয়ার অর্থনীতির প্রাণশক্তি। ২০২২ সালের ইউরোপের দেশগুলোর রাশিয়া থেকে ১৩ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করত। ওই সময় এশিয়ার দেশগুলো রাশিয়া থেকে ১২ লাখ ব্যারেল তেল আমদানি করত। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে রাশিয়া থেকে ইউরোপে তেল কেনার পরিমাণ ১ লাখ ব্যারেলের নিচে নেমে এসেছে। পক্ষান্তরে এশিয়ার বাজারে রাশিয়ার তেলের বিক্রি বেড়ে ২৮ লাখ ব্যারেল হয়েছে।
ইউরোপে যে তেলের বাজার হারিয়েছে, তার তুলনায় এশিয়ার বাজারে তেলের চাহিদা আরও বেড়েছে। রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয়েছে ভারত। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে দেশটি প্রতিদিন ১৪ লাখ ব্যারেল তেল কিনছে।
চীনের তেল আমদানিও খুব বেশি পিছিয়ে নেই। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ চীন প্রতিদিন রাশিয়া থেকে ৮ লাখ থেকে ১২ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে। নিষেধাজ্ঞার এক বছরের মধ্যেই ভারত, চীন, তুরস্ক, উপসাগরীয় দেশগুলো মিলে ইউরোপে রাশিয়া তেলের যে বাজার হারিয়েছে, সেই শূন্যতা পূরণ করে দিয়েছে।
পশ্চিমা রপ্তানিকারকেরা রাশিয়া থেকে সরে আসায় এশিয়ার রপ্তানিকারকেরা এখন রাশিয়ার বাজারে সেই শূন্যতা পূরণ করেছে। চীনের কোম্পানিগুলো এখন নতুন কারের ৪০ শতাংশ ও স্মার্টফোনের ৭০ শতাংশ বাজার দখল করে নিয়েছে।
চীন ও হংকং থেকে রাশিয়া মাইক্রো চিপস আমদানি করে। যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়া মাইক্রো চিপসের মজুত গড়ে তুলেছিল। কিন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধের কারণে একপর্যায়ে রাশিয়াতে মাইক্রো চিপসের ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায়। সেটা কাটিয়ে উঠতে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপণ্য ও মাইক্রো চিপস পশ্চিমা দেশগুলো ও এর মিত্রদেশগুলো থেকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মাধ্যমে রাশিয়াতে প্রবেশ করছে।
দ্য ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অনুসন্ধানে জানা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য ব্যাপকভাবে কমে গেলেও আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তানের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। এটা বিকল্পভাবে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যই।
বিকল্প এই বাণিজ্যের সুযোগ খুলে যাওয়ায় মধ্য এশিয়ার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক পণ্যের আমদানি বেড়েছে। ২০২২ সালে চীন, বেলারুশ, তুরস্ক, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তান থেকে রাশিয়াতে যে পরিমাণ রপ্তানি বেড়েছে, তা ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে যে পরিমাণ রপ্তানি কমেছে, তার সমান।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে নিম্নমুখী করলে এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য পুনর্বিন্যস্তের মাধ্যমে দেশটি তার অর্থনীতিকে টেকসই রাখতে পেরেছে। চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার অর্থনীতিকে রমরমা করে তুলেছে। এই ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে পশ্চিমা বিশ্ব যদি আরও নিষেধাজ্ঞা দিতে চায়, তাহলে তাদের চিন্তা করতে হবে।
নিকোলাস মালডার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত