‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ আওয়ামী লীগ সরকারও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে প্রমাণ করল আইনটি নিবর্তন ও নিপীড়নমূলক ছিল।
এই আইনে কারও বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলেই তাঁকে জেলখানার ভাত খেতে হতো। জেলখানা থেকে মামলা লড়ে সবার পক্ষে বাইরে বের হওয়া সম্ভব হয় না। যেমন মুক্ত লেখক মুশতাক আহমদ এই মামলার খড়্গ নিয়ে কারাগারেই মারা গেছেন। এই আইনের আরেক শিকার সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম ওরফে কাজল কারাগারে নীত হওয়ার আগে কয়েক মাস কোথায় ছিলেন, কেউ জানেন না। এই আইনে গ্রেপ্তার হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা এক বছরের বেশি সময় কারাগারে আছেন; যদিও নারী, শিক্ষার্থী ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি হিসেবে তিনি জামিন পাওয়ার দাবিদার ছিলেন।
গত বুধবার জাতীয় সংসদে সাইবার নিরাপত্তা আইনটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ভেতরে–বাইরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি রহিত হয়ে যায়। কিন্তু এই আইনে যাঁরা আটক আছেন কিংবা যাঁদের নামে মামলা আছে, তাঁদের জন্য কোনো সুখবর নেই।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল হলেও এই আইনের অধীন মামলাগুলো চলবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আইনমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। রাষ্ট্র তাদেরই ক্ষতিপূরণ দেয়, যারা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে। রাষ্ট্র তাদেরই ক্ষতিপূরণ দেয়, যারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে গরিব ভোক্তাদের পকেট কাটে। ডিজিটাল আইনে আটক গরিব সাংবাদিক, কার্টুনিস্ট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীকে কেন ক্ষতিপূরণ দেবে?
এ ক্ষেত্রে মন্ত্রী মহোদয় যে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়েছেন, তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই অনুচ্ছেদে আছে, ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এই রূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্নদণ্ড দেওয়া যাইবে না।’
কিন্তু যেখানে অপরাধই সংঘটিত হয়নি, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার বা শাস্তি হবে কী করে? আইনটি তো করাই হয়েছিল সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করতে এবং ভিন্নমতকে দমন করতে। প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি গত মার্চে একজন দিনমজুরের বরাত দিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিলেন; যাতে সরকার কিংবা কোনো মন্ত্রী সম্পর্কে কোনো কথা ছিল না। তা সত্ত্বেও সিআইডি পরিচয়ে রাতে তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ২০ ঘণ্টা পর তাঁর নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়। তিনি বর্তমানে জামিনে থাকলেও মামলা চলমান আছে। গণতান্ত্রিক সমাজে সরকারের সমালোচনা, ভিন্নমত পোষণ কিংবা একজন দিনমজুরের কষ্টের কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা অপরাধ হতে পারে না।
এই আইনে দায়ের করা সাত হাজার মামলার মধ্যে যদি মাত্র ২ শতাংশের বিচার হয়ে থাকে, ধরে নিতে হবে বাকি মামলাগুলো ছিল হয়রানিমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই আইনে তদন্তকারী কর্মকর্তার ৯০ দিনের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করার কথা। বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি আরও ১৫ দিন সময় নিতে পারেন। কিন্তু যেসব মামলার তদন্তকাজ মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ঝুলে আছে, সেগুলো রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে। সরকার বিচার বিভাগীয় কমিশন করে মামলাগুলো পর্যালোচনা করতে পারত। কিন্তু তারা সেদিকে যায়নি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যথার্থই বলেছে, কেবল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারচর্চার কারণে যাঁদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তাঁদেরকে অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে মুক্তি এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করা হোক।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি অসংগত ছিল বলেই সরকার তার স্থলে সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে একটি নতুন আইন করেছে। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল সরকার ওপরে কিছুটা রং পরিবর্তন করলেও ভেতরের কাঠামো ও চরিত্র একই আছে। এ কারণে কেউ একে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’, কেউ ‘আইনি সংস্কারের নামে তামাশা’ বলে অভিহিত করেছেন।
সাইবার নিরাপত্তা আইন পাসের ক্ষেত্রে সরকার অংশীজনদের মতামত নিলেও খুব আমলে নিয়েছে বলা যাবে না। নতুন আইনে ১০টি ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে, যা আগের আইনে অজামিনযোগ্য ছিল। নতুন আইনে শাস্তির মেয়াদ ও পরিমাণ কমানো হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আইনে যেগুলো অপরাধ বলে শনাক্ত করা হয়েছে, সেগুলো আদৌ অপরাধ কি না। অন্য আইনে আইনে মানহানিসহ অন্য যেসব অপরাধের বিচার করার সুযোগ আছে, সেটা এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হলো কেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত কিংবা মানহানিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর সর্বসম্মত ও সর্বজনগৃহীত কোনো সংজ্ঞা আছে কি? কেউ বলতে পারেন, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ কিংবা ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে না পারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আঘাত। সরকার এই যুক্তি মেনে কি এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করবে?
অংশীজনদের প্রধান দাবি ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জনমনে যে আতঙ্ক ছিল, নতুন আইনে সেটা দূর করা হো্ক। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং সর্বোপরি মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ রয়ে গেছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও মালামাল জব্দ করার বিধান রেখে দেওয়া হয়েছে। তা–ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে নয়, একজন পুলিশ কর্মকর্তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এর মাধ্যমে পুলিশকে যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ২১ ও ২৮ ধারার বিলুপ্তি এবং অন্য ৮টি ধারা পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিল। এই ধারাগুলো বাক্স্বাধীনতা ও মুক্ত সাংবাদিকতার পরিপন্থী। কিন্তু সরকার তা–ও আমলে নেয়নি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানিমূলক মামলার দুটি উদাহরণ দিই। সুনামগঞ্জের ঝুমন দাশ কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক কোনো কথা বলেননি। এরপরও এই আইনের মামলায় তাঁকে কয়েক মাস জেল খাটতে হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ২০১৬ সালে সংঘটিত সংঘর্ষের ঘটনায় দরিদ্র জেলে রসরাজ দাসের বিরুদ্ধেও একই আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এ ধরনের কত মানুষ যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের শিকার হয়ে হয়রানি ও নির্যাতনভোগ করছেন, তার হিসাব নেই।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দেশে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল, নতুন আইন তা প্রশমন করতে পারেনি। এই আইনেও পুলিশকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো সাইবার নিরাপত্তা আইনেও সেই ভয় থেকে গেল।
অনেকেই মনে করেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনী বৈতরণি পার হতেই সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছিল। তাহলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার উদ্দেশ্যও কি এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে ২০২৪–এর নির্বাচনটিও নির্বিঘ্নে করে ফেলা যায়?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি