১০ ডিসেম্বর নিয়ে মাসখানেক ধরেই হইচই হচ্ছে। এর নানা পর্ব দেখা যাচ্ছে প্রথমে শুনেছিলাম, এক পক্ষ ওই দিন গণেশ উল্টে দেবে। এ নিয়ে অন্য পক্ষ ছিল বেজায় ব্যাজার। তারা আস্তিন গুটিয়ে বলল, খেলা হবে।
চারদিকে বেশ মার মার-কাট কাট ভাব। কয়েক দিন পর উত্তেজনার পারদ কিছুটা নেমে এল। শুনলাম, ওই দিন সে রকম কিছু ঘটবে না। যাঁরা হুংকার দিয়েছিলেন তাঁরা বললেন, সেদিন তাঁরা ঘোষণা দেবেন চূড়ান্ত কর্মসূচির। সরকারকে না হটিয়ে তাঁরা ঘরে ফিরবেন না। অন্য পক্ষের মনে স্বস্তি এল কি না, জানি না। তবে তাঁদের সুরে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা গেল।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর রস ছেড়ে করুণ রস উগরে দিলেন, ‘যে বুলেট বঙ্গবন্ধুকন্যাদের এতিম করেছে, সেই বুলেট খালেদাকেও বিধবা করেছে।’ তবে তিনি আরেকটি কথা বলেছেন, ‘ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। এটা বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি। ইতিহাস কোনো স্বৈরাচারী প্রভুর রক্তচক্ষুকে ভয় করে না। ইতিহাসের আদালতের বিচার থেকে কেউই রক্ষা পাবে না।’ (প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০২২) প্রকারান্তরে তিনি বললেন, ‘ইতিহাসের বিচারেই’ দুজন এতিম হয়েছেন এবং একজন বিধবা হয়েছেন।
তিনি কি বুঝে বলেছেন, নাকি যাত্রার বিবেকের মতো নিয়তির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, তার ব্যাখ্যা তাঁর দল চাইতে পারে। তবে ‘ইতিহাসের বিচারে’ তিনি এক রকমের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দেখিয়ে দিলেন।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। বিএনপি ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে ‘গণসমাবেশ’ করার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগেও দলটি সেখানে অনেকবার সমাবেশ করেছে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই। কর্তৃপক্ষ বলছে, বিএনপি নয়াপল্টন অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার জন্য আবেদন জানিয়েছিল। এবার কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়েছে, রাস্তা আটকে সমাবেশ করলে জনদুর্ভোগ হয়। সুতরাং জনদরদি কর্তৃপক্ষ এবার সেটি করতে দেবে না। তারা শর্ত সাপেক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। শর্ত একটি-দুটি নয়—২৬টি। যাঁরা সমাবেশে আসবেন, তাঁরা হাতে শর্তের তালিকা দেখতে দেখতে আসবেন, পাছে না কোনো শর্ত ভঙ্গ হয়। এত শর্ত মুখস্থ রাখতে গেলে জিপিএ টেনেও কুলাবে না!
বিএনপি বলে যাচ্ছে, তারা নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে, এমনকি অনুমতি না পেলেও। এ তো রীতিমতো চ্যালেঞ্জ! আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিএনপি বাড়াবাড়ি করলে ‘সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে’। ব্যবস্থা কী হতে পারে, তা অতীতের নানান ব্যবস্থাপত্রের অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই বোঝা যায়। পত্রপত্রিকার খবর বলছে, বিএনপি নয়াপল্টনে বিনা অনুমতিতে সভা করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চড়াও হবে দলটির ওপর। পথে পথে বাধার সৃষ্টি করবে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন। সবকিছু মিলিয়ে ১০ ডিসেম্বরের বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে বেশ উত্তাপ তৈরি হয়েছে।
কোনো দলের কোনো নেতা গুলি খেয়ে মারা গেছেন বলে আজতক শুনিনি। প্রাণ যায় নিরীহ পথচারীর। যদি কাউকে দলের লোক হিসেবে দেখানো যায়, তখন তাঁকে নিয়ে কয়েক দিন মাতম হয়। তারপর সুনসান নীরবতা। গরিবুল্লাহদের খবর কেউ রাখে না। ১৯৫২ সাল থেকেই এ রকম দেখে আসছি। এ এক মজার খেলা।
বিএনপি কেন নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায়? সম্ভবত, তারা জায়গাটিকে অধিক স্বস্তিকর ও নিরাপদ মনে করে। সেখানে তাদের কেন্দ্রীয় অফিস। তারা মনে করে, এটা তাদের নিজের এলাকা। তারা হয়তো ধরেই নিয়েছে, সরকার তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বরাদ্দ দেবে না। এখন সরকারের ইচ্ছার কাছে ‘নতজানু’ হলে লোকে কী বলবে? আবার সরকারের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে নয়াপল্টনে সভা হলে সরকারের ‘দুর্বলতা’ ধরা পড়ে যাবে না তো? সুতরাং এটা এখন ইগোর প্রশ্ন বা ইজ্জতের লড়াই। আমরা তো সবাই ‘জান দেব তবু মান দেব না’ চেতনায় উজ্জীবিত জাতি!
এ প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলতে চাই। এখন আমরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হয়ে গেছি। দূরদূরান্ত থেকে লোক আনিয়ে মাঠ ভর্তি করে রাজনৈতিক ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের দিন কি আর আছে? একসময় ঢাকার বড় বড় জনসভা হতো আরমানিটোলা ময়দানে।
তারপর ঢাকার আকার বাড়তে থাকল। জনসভার স্থান হয়ে উঠল পল্টন ময়দান। ১৯৭৮ সালের দিকে পল্টন ময়দান থেকে রাজনীতির উৎখাত শুরু। তখন আমার বন্ধু আবু করিম গোটা একটা কবিতার বই বের করে ফেললেন—পল্টনে আবার জনসভা হবে। মাঝখানে ঢাকা স্টেডিয়ামের টিকিট ঘরের ছাদকে নিখরচায় মঞ্চ বানিয়ে অনেক জনসভা হয়েছে। সেখানে মাইক বাজালেই কয়েক হাজার লোক হয়। একবার ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছিলেন, ‘ঐতিহাসিক বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে’ জনসভা করা সহজ। সেখানে প্রতিদিন বিকেলে বাদাম খেতেই কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়।
জনসভা পল্টন ময়দানে আবার ফিরে এসেছিল। তবে সেটি বেশি দিন চলেনি। ১৯৬৯ সাল থেকেই বড় জনসভার জন্য বিকল্প হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ব্যবহার হয়ে আসছে। সেখানে শুধু জনসভা নয়, অনেক দলের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিল সভাও হয়েছে। নানা খোঁড়াখুঁড়ি আর গাছ কাটার পরও যথেষ্ট খোলা জায়গা আছে। সেখানে সভা করা যেতেই পারে।
প্রশ্ন হলো, ময়দানে জনসভা করতে হবে কেন? এখন তো অনেকগুলো টিভি চ্যানেল। নেতারা তো সেখানে স্লট ভাড়া নিয়ে ভাষণ দিতে পারেন। সরকারে থাকলে অবশ্য স্লট ভাড়া নেওয়ার দরকার পড়ে না। চ্যানেলগুলো এমনিতেই ‘পর্বতের’ কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এ ছাড়া বিকল্পও আছে।
নেতারা ফেসবুক লাইভে আসতে পারেন, ইউটিউবে তাঁদের কথা ছড়িয়ে দিতে পারেন। আমার মনে আছে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় বিএনপির চেয়ারপারসন চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দলের প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালাতে অনেক জায়গায় যেতে পারেননি। তখন অনেক জায়গায় তাঁর ভিডিও ভাষণ প্রচার করা হয়েছিল। সেটি কাজে দিয়েছিল।
রাস্তায় জনসভা করলে জনগণের কষ্ট হয়, এটা সবাই জানেন, বোঝেন। সকাল থেকেই যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। এর রেশ থেকে যায় মাঝরাত অবধি। ছুটির দিনের দোহাই দিলেও এটি সমর্থন করা যায় না। এ দেশের সিংহভাগ মানুষ কাজ করেন ইনফরমাল সেক্টরে। তাঁদের কোনো ছুটিছাটা নেই। তাঁদের বেশির ভাগই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। পথে বেরোতেই হয়। রাজনীতিবিদেরা কি তাঁদের কথা ভাববেন না?
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা হলে কী হয়, তা-ও দেখেছি। জায়গাটি শহরের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। মানুষ তো সেখানে উড়ে যাবেন না। তাঁরা যাবেন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে রাস্তা আটকে মিছিল করে। সুতরাং পরিণতি একই। এমনিতেই ভয়াবহ যানজটে নগরবাসী নাকাল। তার ওপর শহরের মাঝখানে জনসভা হলে জীবনযাত্রা অচল তো হবেই।
মতপ্রকাশ বা জনসভা করার অধিকার ‘গণতন্ত্রসম্মত’। এটা সাংবিধানিক অধিকার, এ কথাই বরাবর শুনে আসছি। তো আপনারা কি নাগরিকদের চলাফেরা বন্ধ করে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন? শুনতে পাই, ঢাকায় নাকি দেড়-দুই কোটি লোকের বাস। রুটিরুজি বা অন্যান্য দরকারি কাজে তো এর অর্ধেকসংখ্যক লোককে পথে বের হতে হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হন ঢাকার বাইরে থেকে আসা আরও কয়েক লাখ লোক, যাঁদের আমরা বলি ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জার’। তাঁদের কথা কি দলগুলো ভাববে না?
১০ ডিসেম্বর ঘনিয়ে আসছে। দুই পক্ষই জিবে শাণ দিচ্ছে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ আতঙ্কে আছে। কোনো রকম গন্ডগোল হলে পুলিশ ‘উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে মৃদু লাঠিচার্জ, তারপর কাঁদানে গ্যাস এবং শেষমেশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়’।
কোনো দলের কোনো নেতা গুলি খেয়ে মারা গেছেন বলে আজতক শুনিনি। প্রাণ যায় নিরীহ পথচারীর। যদি কাউকে দলের লোক হিসেবে দেখানো যায়, তখন তাঁকে নিয়ে কয়েক দিন মাতম হয়। তারপর সুনসান নীরবতা। গরিবুল্লাহদের খবর কেউ রাখে না। ১৯৫২ সাল থেকেই এ রকম দেখে আসছি। এ এক মজার খেলা।
আওয়ামী লীগ যত্রতত্র সভা-সমাবেশ করে বেড়াচ্ছে, কেউ তাদের বাধা দিচ্ছে না। অন্যেরা করতে গেলে তাদের এত গাত্রদাহ কেন? নিজেরা যা খুশি তাই করবে আর অন্যদের ওপর মোড়লিপনা করবে, তা হতে পারে না।
সরকার আগে বলুক রাস্তায় কিংবা মাঠে, মানুষকে কষ্ট দিয়ে আর মিছিল-মিটিং করবে না। নিজেরা এমন ঘোষণা দিয়ে অন্যদের তা অনুসরণ করতে বলুক। দলের প্রচারের জন্য অনেক বিকল্প মাধ্যম আছে। সেগুলো ব্যবহার করুক। একটু আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করুক। রাজনীতি তো মানুষের জন্যই। তা-ই না?
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক