সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা কতটা প্রতিফলন করছে

‘যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ’—এ অঞ্চলে প্রচলিত ও বহুল চর্চিত একটি প্রবচন। প্রায় ছয় মাস হতে চলল ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের হাত ধরে ক্ষমতায় আসা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ওই বহুল চর্চিত প্রবচনের কথাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। অনুমান করতে পারছি যে এই তুলনা সরকারের আশপাশের ব্যক্তিদের তো বটেই, অন্য আরও অনেকেরই ভালো লাগবে না। এমনকি ‘লঙ্কা’ ‘রাবণ’—এই বিষয়গুলো আমাদের সংস্কৃতিতে চাপিয়ে দেওয়া কি না, সেটা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়ে যেতে পারে।

প্রবচনের কথা পাশে রেখে বরং মূল বিষয়ে আসি। এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, গত এক-দেড় দশকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ এ বিষয়ে একমত হবেন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬-এর ৫৭ ধারা, এরপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এবং সর্বশেষ সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বিগত স্বৈরাচারী শাসনামলে (২০০৯-২০২৪) বিভিন্ন সময়ে এই আইনগুলো হয়ে উঠেছিল ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা সাইবার স্পেসে মানুষের মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা বা হুমকি এবং ভিন্নমত দমনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বহুল আলোচিত-সমালোচিত, দমন-পীড়নমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের কথা বলে সরকার আগের আইনটি বাতিল করে নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪ পাস করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এরই মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদন করেছে।

নতুন অধ্যাদেশে কোনো ইতিবাচক অন্তর্ভুক্তি নেই, এ কথা বললে অন্যায় হবে। তবে এটাও বলতে হবে যে আগের আইনগুলোর অনেক নিপীড়নমূলক বিষয়ই এখানে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এমনকি উদ্বেগ সৃষ্টিকারী কিছু নতুন বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এগুলো নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমকর্মী, সমাজকর্মী ও মানবাধিকারকর্মীদের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। আপত্তি ও উদ্বেগের কারণ এবং এ-সংক্রান্ত সুপারিশসহ তাঁরা তুলে ধরেছেন।  
উদ্বেগের কারণগুলো পুনরাবৃত্তি না করে আমরা বরং ‘লঙ্কায় গিয়ে রাবণ বনে যাওয়ার’ ওপর আলোচনা করি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকা দুজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা পূর্ববর্তী নিপীড়নমূলক ডিজিটাল  নিরাপত্তা আইনের ভুক্তভোগী। আরও কয়েকজন উপদেষ্টা এসব আইনের বিরুদ্ধে বিগত দিনে ধারাবাহিকভাবে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন।

যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের দিকদর্শী এবং যে রাজনৈতিক কর্মীরা এই অভ্যুত্থানের অগ্রভাগের সৈনিক, তাদের জন্য গত এক দশক আইনি নিপীড়নের অন্যতম হাতিয়ার ছিল পূর্বোক্ত আইনগুলো। সাত হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে এই আইনগুলো ব্যবহার করে, যার মধ্যে পাঁচ হাজারের ওপরে মামলা এখনো চলমান।  
এমন পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ এক চরম বিস্ময় হিসেবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। ভুক্তভোগীমাত্রই একই রকম অন্যায়-অত্যাচারের ঘটনায় অন্যের প্রতি সহমর্মী হবেন—এ ধারণা যে ভ্রান্ত, তা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি। ভুক্তভোগীর প্রতিশোধপ্রবণতাও আমরা বিস্তর দেখেছি। তেমন মনস্তত্ত্বই কি এ ক্ষেত্রেও কাজ করছে?
‘আমরা এখন ক্ষমতায় অথবা ক্ষমতার কাছাকাছি; সুতরাং আমাদের বিরুদ্ধে তো আর এই আইন ব্যবহার হবে না’—এমন ধারণা কি ক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের মধ্যেই প্রবল? কিন্তু ক্ষমতার মসনদ যে চিরস্থায়ী নয়, সেটা কি আমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম? এমনকি জুলাইয়ের রক্তের দাগ না শুকাতেই!

আমরা কি দেয়ালে আঁকা সেই গ্রাফিতিগুলো এরই মধ্যে ভুলে গেলাম? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল চেয়ে দেয়াললিখন, কার্টুনের মতো আরও অনেক কিছুই যে আমরা ভুলে গেছি, তার কিছু প্রমাণ অবশ্য আমরা ইতিমধ্যেই দিয়ে ফেলেছি। নিপীড়নমূলক সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুমোদন দিয়ে, নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’ গ্রাফিতিটি বাদ দেওয়ার বিষয়টি কি সে রকম কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে না?

স্মরণে রাখতে অনুরোধ করি, লঙ্কায় গিয়ে রাবণের যেমন রক্ষা হয়নি; আমাদেরও রক্ষা হবে না যদি রাবণ চরিত্র আমাদের পেয়ে বসে। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের শিক্ষা তো সেটাই।

  • সাঈদ আহমদ মানবাধিকারকর্মী ও বাংলাদেশ ব্যুরো মেম্বার, সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (এসএএইচআর)