সাংবাদিক হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর একটি হলো খেয়ার্ট ভিল্ডার্সকে অবমূল্যায়ন করা, যিনি কিনা বর্তমানে নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতা এবং যিনি কিনা দেশটির প্রথম উগ্র ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।
উগ্রপন্থী মুসলমানদের হাতে চিত্রনির্মাতা থিও ভ্যান গঘের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে আমি মার্ডার ইন আমস্টারডাম বইটি লেখার সময় ২০০৫ সালে ভিল্ডার্সের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ভিল্ডার্স তখনো দ্য পার্টি ফর ফ্রিডম (পিভিভি) নামের রাজনৈতিক দলটি গঠন করেননি। তিনি দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ২০০৬ সালে।
তবে ইসলামের কট্টর সমালোচক এবং মুসলিম পটভূমি আছে, এমন অভিবাসীদের বিরোধিতাকারী হিসেবে তাঁর বক্তব্যের বিষয়ে আমি আগ্রহী ছিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি তখন তাঁকে নিতান্ত গোঁয়ার প্রকৃতির বলে মনে করেছিলাম। আমি ধরে নিয়েছিলাম, তাঁর কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরও তাঁর কোনো বক্তব্যকে আমি আমার ওই বইয়ে উদ্ধৃত করিনি।
বেশির ভাগ লোকের মতো আমিও তাঁর চুলের অদ্ভুত স্টাইলে আটকে গিয়েছিলাম। আমি তখন ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ও পার্লামেন্ট সদস্য তাঁর মাথার কালো চুলকে কেন প্লাটিনামের রঙে রাঙাতে চান? আদতে চুলের অনন্য স্টাইল তৈরিতে তিনি রাজনীতিকদের মধ্যে কিছুটা অগ্রগামীই ছিলেন বলা যায়। পরের দিকে রাজনীতিতে হাজির হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বরিস জনসনের সাফল্যের পেছনেও ‘দর্শনধারী’ বিষয়টি কাজ করেছে বলে মনে করা হয়।
ট্রাম্প ও বরিস জনসন উভয়ের মাথার চুলের এলোমেলো ও উদ্ভট স্টাইল মানুষকে আকৃষ্ট করেছে (সম্ভবত হিটলারের টুথব্রাশের মতো গোঁফ, এমনকি নেপোলিয়নের চিরুনিতে আঁচড়ানো সুবিন্যস্ত চুলও একই ধরনের ভূমিকা রেখেছিল)। তবে ভিল্ডার্সের চুলের স্টাইলের আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে। ২০০৯ সালে ডাচ নৃবিজ্ঞানী (যিনি ইন্দোনেশিয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ) লিজ ভন লিউভেন বলেছিলেন, ভিল্ডার্স হয়তো চান না তাঁর ইউরেশীয় শিকড়ের কথা সবাই জেনে যাক।
তিনি হয়তো নিজেকে খাঁটি পশ্চিমা হিসেবে তুলে ধরতেই কালো চুলকে রং দিয়ে প্লাটিনামের রঙে রাঙিয়েছেন। ভিল্ডার্সের নানি ছিলেন আংশিক ইন্দোনেশীয়। তাঁর দাদা-দাদিকে আর্থিক অনিয়মের জের ধরে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এ দুটোর কোনো ব্যাখ্যাকেই খেয়ার্ট ভিল্ডার্সের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো উচিত হবে না। বর্ণ ও জাতপাত কোনো কিছুকে ব্যাখ্যা করার মাপকাঠি হতে পারে না। তবে সাবেক ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ শাসনামলে ইউরেশিয়ানদের মধ্যে যে উগ্র ডান ও মুসলিমবিরোধী মনোভাবের ইতিহাস পাওয়া যায়, সেই প্রেক্ষাপট ভিল্ডার্সের রাজনৈতিক ভাবাদর্শকে বুঝতে সহায়তা করতে পারে।
ইউরেশিয়ান বা ইন্দোদের কখনোই ইন্দোনেশিয়ান বা তাদের ডাচ ঔপনিবেশিক প্রভুরা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেনি। তারা জন্মগতভাবেই বহিরাগত। ইউরেশিয়ান লোকদের মধ্যে যে যত শিক্ষিত হয়েছিল, সে তত স্থানীয় হতে চেয়েছে। এর ফল ছিল ইসলামের প্রতি ঘৃণা ও চরম ডাচ জাতীয়তাবাদ।
১৯৩০–এর দশকে উপনিবেশের ডাচ নাৎসি পার্টিতে অনেক সদস্য ছিলেন, যাঁরা ইউরেশিয়ান বংশোদ্ভূত ছিলেন। ভ্যান লিউয়েন যেমনটা উল্লেখ করেছেন, এই সময়ে নাৎসি পার্টি ইন্দো বংশোদ্ভূতদের ‘ডাচদের চেয়ে বেশি ডাচ’ করে গড়ে তুলেছিল।
ভিল্ডার্স হয়তো ফ্যাসিবাদী নন। কিন্তু সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বত্ব এবং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশুদ্ধতার প্রতি তাঁর মোহ বহিরাগতদের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা প্রায়ই আশপাশের এলাকা থেকে ‘আবির্ভূত’ হয়েছেন। কর্সিকা থেকে নেপোলিয়ন, জর্জিয়া থেকে স্তালিন এবং অস্ট্রিয়া থেকে হিটলারের উত্থান হয়েছেন।
এসব নেতা ভিল্ডার্সের রাজনৈতিক মননে এমনকি নেদারল্যান্ডসের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ১৯৮০ সালে হেনরি ব্রুকম্যান অভিবাসনের বিরোধিতা (বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসনের বিরোধিতা) করার জন্য উগ্র ডানপন্থী ডাচ সেন্টার পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রুকম্যানের মতো অন্য ডানপন্থী রাজনীতিবিদেরাও এখানে উগ্র ডানপন্থী দল গঠন করেছেন।
এই দলগুলো লাগাতারভাবে মুসলিমবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। অভিবাসীদের, বিশেষ করে মুসলিম অভিবাসীদের তারা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ভিল্ডার্সের উত্থান হয়েছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
ইয়ান বুরুমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল বইয়ের লেখক