একটা ময়লা ও দুর্গন্ধ বোঝাই উপত্যকা। পাশে ঝিম ধরা এক জলকূপ। না আছে স্রোত, না আছে ফুটন্ত পদ্ম বা পানা ফুল, বা কোনো সোনালি-রুপালি মাছ। নগরের শ্মাশানখলা, উকিলপাড়া, গরুহাট্টাসহ নানা মহল্লা থেকে ফেলা ময়লার ভাগাড় বর্ষায় দগদগে ঘায়ের মতো পেকে-গলে একাকার হয়ে যায়। নর্দমাঘেঁষা জলাপাড়ে শেওলা চিটচিটে পাথর কটা পিচ্ছিল থেকে পিচ্ছিলতর হয়।
ওখানে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে বা বসে হরিজনপল্লির বউ-ঝিয়েরা কাপড় কাচে, ঘরকন্নার কাজ করে। শিশুরা ময়লা শরীরে সাবানের ফেনা ছড়িয়ে ডোবায় লাফিয়ে পড়ে। ময়লা জলে গা ধুইয়ে কুচকুচে কালো শরীর শোঁ শোঁ করে এলোপাতাড়ি ছুটে আর জল ছিটিয়ে খেলা করে।
অচ্ছুতের কাছ থেকে গা বাঁচাতে ভদ্রলোকেরা সহজে ও পল্লি মাড়ায় না। ওদের পালিত শূকর ড্রেনে-ডোবায় লুটোপুটি খায়। শূকরের ভোঁটকা গন্ধে ভদ্রলোকদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। অপারগতায় অনেকে নাকে আঙুল চেপে, ওয়াক থুতু শব্দে কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে ছোটে মালগুদাম হয়ে কোর্ট স্টেশন, শ্মাশানখলা অথবা উকিলপাড়ার দিকে। অথচ এই মানুষগুলো সভ্য মানুষের তৈরি করা ময়লার ভাগাড় দুহাতে পরিষ্কার করে, তার মধ্যেই জীবন পাড়ি দিয়ে চলেছে।
এত গেল বাহিরানা। ঘরানার চিত্র আরও ভয়ংকর। ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া ১০/১২ বর্গফুটের ঘরখানিতে যুগের পর যুগ ধরে কেবল বংশবিস্তারই ঘটেছে, ঘরের আয়তন বাড়েনি। ছোট্ট ঘরে গড়ে ১০ থেকে ১৫ জনের ঘিঞ্জি বাস।
বহু বছরের পুরোনো বিদ্যুতের সংযোগ, ফুটো চাল, ড্রেনের জলে হাঁটু ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি টিউবওয়েল, বাথরুমঘেঁষা টাইম কল। ড্রেনের থই থই জল পেরিয়ে যেখানে পৌঁছাতে হয়।
তারই পাশে এনজিওর অর্থায়নে শিক্ষালয়। প্রকল্প আছে তো সরস্বতী আছে, প্রকল্প নেই তো সরস্বতী উধাও। তুমুল গপ্প, তর্কবিতর্ক, আচমকা চুলোচুলি, দারুর খুঁজে বাঙালিদের আনাগোনা, মধ্যরাতে হঠাৎ হঠাৎ পুলিশবাবুদের হানা, ওপারের বাঙালি সুইপারদের সঙ্গে হঠাৎ মল্লযুদ্ধ—এই হলো এদের জীবনছবি। অভাব, ক্ষুধা, অজ্ঞতা, অবিচার, অত্যাচার, অসম্মান, অসময়ে বিয়ে-বৈধব্য, কলহ-বহুবিবাহসহ নানা নিপীড়নের সঙ্গে এদের সহবাস।
একটু শৈশব পরিভ্রমণ করে আসা যাক। ভোরের আজানের সঙ্গে পড়তে বসার চল ছিল তখন। রাত শেষে মোয়াজ্জিনের মধুময় সুর, আখড়ার ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে বারহাট্টা রোডের প্রশস্ত রাস্তা থেকে ভেসে আসত একলয়ে বাজতে থাকা ঝাড়ের শব্দ।
স্মৃতিপটে এখনো ভাসমান, টকটকে লাল-হলুদ-কমলা-সবুজ শাড়িতে ফুল তোলা কুঁচি আর কাঁধ ছুঁইয়ে আসা আঁচলের ছড়ানো পেখম। ধুতি-লুঙ্গি-স্যান্ডো গেঞ্জি পরা জমাদার, কবজির ভাঁজে বিশাল লম্বা ঝাড়, কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দূরে দাঁড়িয়ে অবোধ্য ভাষায় রুটি-হালুয়া চাওয়া, বীণাপাণি স্কুলের পেছনের বেঞ্চে আঁটোসাঁটো হয়ে বসে থাকা শ্যামা রঙের মেয়েটি, লছমনের পুকুর থেকে জল তোলে মল পরিষ্কারের পর স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিদিমণিদের প্রণাম ঠুকা, চায়ের দোকানে বসে কোমরে গুঁজে রাখা টিনের মগটা বাড়িয়ে দিলে দোকানির স্পর্শদোষ বাঁচিয়ে চা ঢেলে দেওয়া।
কোনোমতে চায়ের টাকা নিয়ে হাত ধুইয়ে ফেলা! আরও কত কী! স্বভাবতই জিজ্ঞাসা জাগে, এরা কারা? যশোবন্ত বাঘেলার ‘ব্যক্তিগত পরিচয়’কাব্য থেকে কিছু লাইন এখানে উল্লেখ্য, ‘এই মাথাটা শম্বুকের, হাত দুটো একলব্যের, এই হৃদয় কবীরের,....কিন্তু এই পা দুটো অস্পৃশ্য এখনো।’
সনাতন ধর্মের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদের প্রথম দিকের শ্লোকে ‘ক্ষত্র’ বা অভিজাত এবং ‘বিশ’ বা সাধারণ মানুষ—এই দুই শ্রেণির অস্তিত্বের কথা জানা যায়। পুরুষ সূক্তের দশম মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত অধ্যায়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—এই চার বর্ণের উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে। পুরুষ সূক্তের শ্লোকে বলা হয়েছে যে আদি পুরুষ ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু থেকে বৈশ্য ও পা থেকে শূদ্রের জন্ম।
বর্ণাশ্রম অনুসারে ব্রাহ্মণ জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিক্ষা ও চিন্তাশক্তিতে পূর্ণ। ক্ষত্রিয় শৌর্য-বীর্যে পূর্ণ। বৈশ্য ব্যবসা ও অর্থ সংগ্রহে উৎসাহী আর শূদ্র স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন, যাদের কাজ ওপরের তিন সম্প্রদায়ের সেবা-শুশ্রূষা করা। তারা শুধু কায়িক পরিশ্রমের উপযুক্ত, সীমিত চিন্তার বাইরে কোনো কাজ করতে পারে না।
বর্ণপ্রথা এমনই এক বিষয়, যা সামাজিকভাবে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত। তাই যারা উচ্চবর্ণে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা সম্মানিত আর যারা নিম্নবর্ণে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা লাঞ্ছিত, অবহেলিত। যেহেতু বর্ণভেদমতে শূদ্রই সবচেয়ে নিম্নশ্রেণির, তাই এই কুলে জন্মগ্রহণ করায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক—সব দিক থেকে তারা অবহেলা-বঞ্চনার শিকার।
‘ধর্ম ও রাষ্ট্র হাত মিলিয়ে নিম্নশ্রেণি; অর্থাৎ শূদ্রকে প্রথমে মানসিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দাসত্বে বন্দী করল, পরে তারা অস্পৃশ্যতার নাগপাশে বাঁধা পড়ল। অস্পৃশ্যদের জীবনযাপন ছিল লজ্জাজনক। তাদের যেমন চাষাবাদের জমি ছিল না, তেমন তাদের কোনো নির্দিষ্ট পেশাও ছিল না। রোদ হোক, বৃষ্টি হোক—তারা উচ্চ শ্রেণির হুকুমমতো কায়িক শ্রম করত। অন্তহীন শ্রমের বিনিময়ে তারা পেত পশুর মতো ব্যবহার। গ্রামের বাইরে এক প্রান্তে পৃথকভাবে তাদের বসবাস করতে হতো এবং উচ্চশ্রেণির মানুষের পরিত্যক্ত দ্রব্য গ্রহণ করতে হতো। তাদের ছোঁয়া লাগলে, এমনকি ছায়া মাড়ালে উচ্চ শ্রেণির স্পর্শদোষ ঘটত।’ (প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা, জয়শ্রী সরকার)
শূদ্র্রদের একটি অংশ উচ্চবর্ণের হুকুমমতো মৃত মানুষ পোড়ানো, মৃত পশু অপসারণ ইত্যাদি নিম্নশ্রেণির কাজ করতে করতে কালক্রমে আলাদা সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে পড়ে। পেশার কারণে তারা হয়ে যায় অতি শূদ্র্র। তাদের থুতু যেন মাটিতে না পড়ে, সে জন্য গলায় মাটির পাত্র বাঁধতে হতো। জুতা পরার অধিকার তো ছিলই না; বরং পায়ের ছাপ যেন রাস্তায় না থাকে সে জন্য পিঠে বেঁধে রাখতে হতো লম্বা ঝাড়। এমনকি তৃষ্ণার জলের জন্যও তাদের নির্ভর করতে হতো উচ্চ বর্ণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।
১৯২৭ সালের ১৯ মার্চ মাহাড়ের চাভাদর সরোবরে জল আনতে গেলে বর্ণ হিন্দুরা দলিতদের আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের প্রতিবাদে ভিমরাও আম্বেদকারের নেতৃত্বে ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর এক জনসভা ডাকা হয়। দলিত আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।
সেখানে তিনি এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা ভাববেন না যে সত্যাগ্রহ সমিতি শুধু চাভাদর লেকের জলপান করার জন্যই আপনাদের ডেকে এনেছে। এমন নয় যে চাভাদর লেকের জল খেলেই আমরা অমর হয়ে যাব। আমরা এই জল না খেয়েই খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকেতে পারব। আমরা লেকের জল পান করার জন্য সেখানে যাচ্ছি না। আমরা সেখানে যাচ্ছি এটাই প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে আমরা অন্যদের মতোই মানুষ।’
আনুমানিক আঠারো শতকের প্রথম দিকে ১৭০৬-১০-এর মধ্যে ভারত উপমহাদেশের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে আগমন ঘটে হরিজনদের। একদিকে অভাব, অন্যদিকে উচ্চবর্ণের নিপীড়ন-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে এ জনগোষ্ঠী বাঁচার নানা পথ খুঁজছিল। এ অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তৎকালীন জমিদার ও ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের নানা প্রলোভন ও প্ররোচনায় হরিজনরাও দেশত্যাগে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এ বঙ্গে পা বাড়ায়। নগরায়ণ তাদের হাতে তুলে দেয় ময়লার ঝাড়।
বাংলাদেশের এমন কোনো শহর নেই, যেখানে হরিজন নেই। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সবার কাছে এরা শুধুই মেথর। মেথর ছাড়াও নিম্নবর্ণের এই জাতিসত্তাকে হরিজন, দলিত, অস্পৃশ্য, অচ্ছুত ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।
বাংলাদেশে বসবাসরত হরিজনেরা পেশাগত দিক দিয়ে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও তাদের মধ্যে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ লক্ষণীয়। তাদের ভাষায়, একেকটি গোত্র থেকেই তাদের নামাকরণ করা হয়েছে। গোত্র বিভাজনে যেসব নাম পাওয়া যায়—বাঁশফোড়, হেলা, হারি, ডোম, বাগদি, ডোমার, তেলেগু, রাউত, লালবেগি, বাল্মিকী, টাঁক, রবিদাস ইত্যাদি। এদের মধ্যে তেলেগু, রবিদাসদের নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
এ সম্প্রদায়ের অনেক গোত্র আবার বৃহৎ গোত্রের সঙ্গে সংকরায়িত হয়ে বিলুপ্তির পথে। হরিজনদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ বা সম্বল হলো সুইপারের চাকরি। দীর্ঘকাল ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের পেশায় নিয়োজিত হরিজনেরা মনে করে, সুইপিং তাদের পৈতৃক পেশা। বর্তমানে এই জনগোষ্ঠী পেশার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশে বসবাসকারী হরিজনদের মধ্যে এরা সংখ্যাধিক্য। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে হরিজনপল্লিতে বাঁশফোড়দের অবস্থান রয়েছে। নেত্রকোনা জেলার গরুহাট্টা-সংলগ্ন হরিজনপল্লির সবাই বাঁশফোড়।
বাঁশফোড়দের আদি নিবাস ভারতের বিহার, কানপুর, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশে। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, বিহারের গোরখ ও ছাপড়া জেলায় এরা সংখ্যাধিক্য। ধারণা করা হয়, ১৮১০ থেকে ১৮৮৯ সালের দিকে দুর্ভিক্ষের শিকার হয়ে পূর্ববঙ্গে চলে আসে বাঁশফোড়দের পূর্বপুরুষের একটি বিরাট অংশ।
ভারতবর্ষে শূদ্র বর্ণের যে সম্প্রদায় বা গোত্র বাঁশ বা বেতের কাজ করত, তাদেরকেই বাঁশফোড় বলা হতো। মূলত বাঁশফোড়ে যে শ্রেণিটা জীবিকা নির্বাহ করত, তারাই বাঁশফোড়। কালের বিবর্তনে শৈল্পিকতা ভুলে মেথর বনে গেলেও এদের আদি পেশা ছিল টুকরি বানানো। বাংলাদেশে বাঁশফোড়দের সংখ্যা ১ লাখের ওপরে।
লাকসাম, শান্তাহার, যশোর, কুমিল্লা, টঙ্গী, কুষ্টিয়া, পাবনা, খুলনা, যশোর, সৈয়দপুর ও বগুড়ায় তাদের বড় পল্লি রয়েছে। পারিবারিকভাবে ভোজপুরি ভাষায় কথা বলে। তাই ধারণা করা হয়, বাঁশফোড়দের আদি ভাষা নাগরি। উল্লেখযোগ্য পূজার মধ্যে কালীপূজা, শীতলাপূজা, ছটপূজা, দোলপূজা। বাঁশফোড় ছাড়াও নেত্রকোনায় ডোম শ্রেণি রয়েছে, যারা লাশ টানা, কাটা ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজ করে। এ এক বঞ্চনা আর তাচ্ছিল্যের জীবন।
‘ঠারে ঠারেভোট লেইকে চল গেয়ি। হামলোগকে চেরম্যান ভুল গেয়া। ভোট লেনে আকে
বোলাথা, কল বাইঠা দেবে, পানিকা অভাব না রাইয়া, যে লোগকো নকরি
নেইকা, ওসকো নকরি দেওকা বেকার কোই না গুরি। পাস কারকা বাবুকো চেহারা নেই দেখা, ভুল গেয়ি।’
(প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা, জয়শ্রী সরকার)
ভিন্নভাষী এ জনগোষ্ঠীর কথা শুধু চেয়ারম্যান নন, সব ধর্মের, সব শ্রেণির মানুষ ভুলে যেতে চায়। কী মানুষ, কী ঈশ্বর—সবার কাছেই এরা অস্পৃশ্যজন। যুগের পর যুগ ধরে কত নদীর গতি পরিবর্তন হয়ে গেল, কত নদী গতি হারালো, কত নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল; কিন্তু হরিজনদের জীবনধারার খুব বেশি একটা পরিবর্তন লক্ষ করা গেল না।
একালেও তারা ভদ্র বসতি এলাকায় জায়গায় কিনতে পারে না, ভদ্রলোকদের সঙ্গে চলতে পারে না, তাদের ঘরের ভেতর ঢুকতে পারে না, একই পুকুরে স্নান করতে গেলে গোল বাধে, একই কল থেকে জল খেতে পারে না। যারা শিক্ষা ও সচেতনতার আলো মেখে পৈতৃক পেশা থেকে বের হতে পেরেছে, তাদের জীবনে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু অস্পৃশ্যতার গ্লানি থেকে মুক্তি মেলেনি। সবাই প্রয়োজনহীন ওমুখো হতে ভয় পায়। ঘাবড়ে যায় এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চৌহদ্দিতে প্রবেশকরণে। একবার দলিত সাহিত্য পাঠকালে কেশব মেশরামের একটি কবিতা প্রাণে রেখাপাত করেছিল, ‘আমাদের মহল্লায়’:
‘আমাদের মহল্লায় ঢুকে ডাকপিয়নেরা ঘাবড়ে যায়
সবকিছু পড়াশোনোও গুলিয়ে যায়
সভ্যতা এখানে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে
এমনকি সূর্যও এখানে কালো হয়ে যায়।
কাদার ওপরে গোরু-বাছুরের পায়ের ছাপের মতো
আমাদের বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকে।’
কালের বিবর্তনে ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছে। আমরা দাবি করি, মানুষ জাতপাতের গণ্ডি থেকে বের হয়ে এসেছে; কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগেও যাদের বসবাস শতাব্দীকাল আগের সেই খুপরিতে, যাদের কাজের স্বীকৃতি নেই, পল্লিতে নিজেদের মতো ঈশ্বরের মন্দির তৈরি করে পুরোহিত ছাড়াই পূজা করতে হয়, নেই ন্যায্য মজুরি, যাদের বাঁচার তাগিদে বাড়তি আয়ের উৎস দারু (চোলাই মদ), ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা নিত্যদিনের সঙ্গী, তারা সাহিত্য রচনার উপাদেয় বটে; কিন্তু সমাজের মূল স্রোতোধারায় ফিরিয়ে আনা ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থায় যে কত কঠিন, তা গান্ধীজি, মহাত্মা ফুলে ও আম্বেদকারের কর্মকাণ্ড থেকে সুস্পষ্ট।
এই মেথররা যদি এক দিনও কাজ বন্ধ রাখে, তাহলে সভ্য সমাজের বসবাসের স্থান প্রতিটি শহর-বন্দর-নগর ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হবে। অথচ এই কাজের কারণেই ভদ্র সমাজ চিরপরিশ্রমী এ জনগোষ্ঠীকে সমাজে আস্তাকুঁড়ে রেখেছে, রেখেছে সমাজের এক প্রান্তে। ভিমরাও আম্বেদকর চরম এক সত্য উপলব্ধি করে বলেছিলেন,
ধনবৈষম্য বোঝা যায় এবং বোঝানো যায়
কিন্তু বর্ণবৈষম্যের স্বরূপ অনুভবের ব্যাপার
প্রথমটা আঘাত করে প্রাণে, পরেরটা অঘাত করে মনে।
প্রান্তবাসী হরিজনদের কথা গবেষণাগ্রন্থটি রচনার আগে বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগের হরিজনপল্লিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। দীর্ঘসময় এই গবেষণার অভিজ্ঞতার পীড়ন থেকে বলছি, নিজেদের স্বার্থে যে মানুষদের পল্লি থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়নি এই সমাজ। তবু নিজেদের প্রচেষ্টায় অনেকে প্রতিষ্ঠিত; কিন্তু তবু নিজের ভিটা বলতে ওই ময়লা-আবর্জনায় ভরা খুপরিকেই মনে করে।
প্রিয় পাঠক, আপনারা সবাই আজ যেখানে আছেন, আপনাদের মূল কি এখানেই? না তো। যত মন্দই হোক, আমাদের প্রাণ সেই মূলের জন্যই কাঁদে। তাই মিরনজিল্লা কলোনির হরিজনদের উচ্ছেদের যে চেষ্টা, সেটি একটি নির্দয় নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত। যদি ওদের সরাতেই হয়, তবে সেটি স্বৈরাচারিভাবে নয়। বাস্তুহারা করার সংস্কৃতি অনাচারের সংস্কৃতি, এই সংস্কৃতি কোনো দিন নিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত হতে দিতে পারে না। রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা, ওদের সঙ্গে বসবে, কথা বলবে, বিকল্প আবাসের ব্যবস্থা করবে। তা না হলে ভিটা হারানোর অভিশাপ এই মাটির জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
জয়শ্রী সরকার কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
ই–মেইল: [email protected]