কিছু মানুষের ‘ন্যায়পরায়ণতা’র অন্ধ নির্বোধ আত্মতৃপ্তি এবং উন্মাদ নিষ্ঠুরতা, প্রতিহিংসা আর নানাবিধ স্বার্থান্বেষণ আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা ভেবে ভয়ে আর অশান্তিতে মনটা কুঁকড়ে আছে।
গত সরকারের প্রতিহিংসা আর দমনমূলক বিচারবহির্ভূত সহিংসতা আমরা অনেক দেখেছি। আর এখন উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচারের নামে একই ধারার ঘটনা দেখছি।
সাধারণ মানুষ আমি নিজের স্বস্তির জন্য এমন একক ঘটনাগুলো মনের পেছনে ঠেলে রাখতে চাই। কিন্তু ঘটনা বাড়ে। একসময় সেগুলো মনের সামনে চলে এসে মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে চোর সন্দেহে এক যুবককে ধরে ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলের অতিথিকক্ষে আটকে দফায় দফায় পিটিয়ে মেরে ফেললেন।
মারের বিরতি পর্বে ‘তোফাজ্জল হোসেন’ নামের যুবকটিকে হল ক্যানটিনে ভাত খাইয়ে নেওয়া কী ধরনের বিকৃত নিষ্ঠুর মনের পরিচয় দেয়, তা কল্পনা করতেও ভয় করি।
একে শুধু ‘মব’ বা উন্মত্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার মন বলে শান্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ কি আছে?
এমন কাজের শিকড় যে মনে, তেমন মনকে কি আমরা চিনি? চেনার চেষ্টা তো করতে হবে। না হলে শুধু সাজা দিয়ে তো এই মানসিকতা তথা অসুস্থতার উচ্ছেদ করা যাবে না।
একই তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল শিক্ষার্থী সেখানকার ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে মারলেন।
সেদিনই খাগড়াছড়িতে পিটুনিতে নিহত হলেন মোহাম্মদ মামুন নামের এক যুবক। সে ঘটনার জের অনেক বড় মাত্রায় চলে যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল ৭ সেপ্টেম্বর।
অভ্যুত্থান পরবর্তী অশান্ত দিনগুলোতে এমন নানামুখী কারণে ঘটে চলা হত্যার হিসাব করলে সংখ্যাটা ছোট হবে না। এমন ঘটনা যদি একটিও হয়, তার তাৎপর্যও অনেক বড় এবং নানামাত্রিক।
খুব ছোট করে বললে, এক ঘটনা অন্য আরও ঘটনা ঘটানোর পথ পরিষ্কার করে দেয়।
একটি একটি করে ঘটনা যখন ঘটেছে, সেসবের কথা আমি তাৎক্ষণিকভাবে মনের পেছনের তাকে তুলে রেখে দিয়েছি। কেননা এগুলো এবং এগুলোর তাৎপর্য তলিয়ে ভেবে, এগুলো সহ্য করে বাঁচা কঠিন অশান্তির ব্যাপার।
অস্বস্তিকর ও নানাবিধ প্রশ্ন তোলা বিষয়কে মন পেছনে ঠেলে দিতে চায়। আমরা সেগুলো ভুলে গিয়ে যে যার নিরাপদ স্বস্তির বলয়ে রোজকার জীবন চালাতে মনোযোগী হই।
আমরা নিজেদের বিপদ টেনে আনতে ভয় পাই। হুমকি-হামলার ঝুঁকি বিচার করি। ট্যাগানো বা ট্যাগ লেগে যাওয়ার বিপত্তি এড়াতে চাই।
কিন্তু এভাবে আমরা ভুলে যাই যে কেউই আসলে নিরাপদ নই। অরাজক যেকোনো চর্চাকে চলতে দিলে সেটার শিকার যেকোনো সময় আমরা নিজেরা যে কেউ হতে পারি।
তা ছাড়া অবিচার, যথেচ্ছাচার, অন্যায় থেকে ক্ষোভের জন্ম হয়। ক্ষোভ জমতে থাকলে প্রবল প্রতাপশালী হীরক রাজার দড়িতেও টান পড়ে। সদ্য পাওয়া এই শিক্ষা ভুলে যাওয়ার কোনো অবকাশ আমাদের নেই।
গত সরকারের আমলে করা সবার দুঃশাসন, নিপীড়ন-নির্যাতন ও অন্যায়-অপরাধের বিচার আমরা অবশ্যই দেখতে চাই। কিন্তু প্রতিহিংসার তাড়নায় অথবা স্বার্থরক্ষার হিসাব-নিকাশ করে করা বিচারবহির্ভূত হত্যা বা নিপীড়ন-নির্যাতন দেখতে চাই না। কেননা তাহলে তো সব আগের মতোই রয়ে যাবে।
গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ের ফসল অন্তর্বর্তী সরকার এবং সেটার অংশী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ সমন্বয়কেরা ‘মব [ইন] জাস্টিস’-এর বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানের কথা বলেছেন, বলে আসছেন।
শুধু কথায় কিন্তু চিড়াও ভেজে না। দুঃখপ্রকাশে তো নয়ই।
বেশ কিছু ঘটনায় অবশ্য মামলা বা আইনিপ্রক্রিয়া ও আটক শুরু হয়েছে। কিছু ঘটনা হয়তো ফাঁকে পড়ে গেছে, এমন সন্দেহ মনে জাগে।
সবার আগে অবশ্যই প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, কর্তৃপক্ষ, সংঘটক-সবার দায় নির্ণয় করে বিচার ও শাস্তি দরকার। সম্ভাব্য সব ‘উচ্ছৃঙ্খল’ জনবিচারক যেন কড়া বার্তা পান, ভয় পান।
কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। আমাদের নিজেদের মনের বিশৃঙ্খলা আর ময়লা বাইরের কেউ কি সাজা দিয়ে দূর করতে পারবে? নিজে এবং পরস্পরে মিলে সেটা দূর করার কাজটি এখনই শুরু হোক।
‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’র হাতে হত্যার আলোচিত ঘটনাগুলোতে উন্মত্ত নিষ্ঠুরতা এবং অন্ধ স্বেচ্ছাচারী ন্যায়ের আস্ফালন তো দেখিই, প্রতিহিংসা আর নানামাত্রিক স্বার্থান্বেষণেরও সরাসরি প্রকাশ দেখি অথবা ইঙ্গিত পাই।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, ১৮ সেপ্টেম্বর নিহত তোফাজ্জল হোসেনের আসল নাম মাসুদ কামাল। তিনি একসময় ছাত্রলীগের একটি ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ছিলেন। পারিবারিক শোকের আঘাতে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।
গত সরকারের আমলে করা সবার দুঃশাসন, নিপীড়ন-নির্যাতন ও অন্যায়-অপরাধের বিচার আমরা অবশ্যই দেখতে চাই। কিন্তু প্রতিহিংসার তাড়নায় অথবা স্বার্থরক্ষার হিসাব-নিকাশ করে করা বিচারবহির্ভূত হত্যা বা নিপীড়ন-নির্যাতন দেখতে চাই না। কেননা তাহলে তো সব আগের মতোই রয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষার্থীরা এমন হত্যার প্রতিবাদে এবং বিচার চেয়ে রাস্তায় নেমেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার হচ্ছেন। আরও তরুণেরা প্রতিবাদী হবেন, সেই আশা করি।
তরুণদের শুভবুদ্ধি আর সত্তার ওপরেই আমরা আস্থা রাখতে চাই। সেই সম্ভাবনার কাছেই আমার আশা ও ইচ্ছাগুলো গচ্ছিত রাখার মতো সুযোগ চাই।
আমি খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে নির্ভয়ে মন খুলে কথা বলতে চাই, চলতে-ফিরতে চাই। আমি চাই, আমার চেয়ে ভিন্ন মতধারা, তরিকা ও জীবনধারার মানুষেরা যেন ন্যায্য জীবন, মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকারগুলো পায়। সবচেয়ে কোণঠাসা গোষ্ঠী আর ব্যক্তিটিও যেন বাদ না পড়ে।
সম্প্রতি একজন বন্ধুর ফেসবুক পোস্টে পড়েছি, বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সূত্র ধরে সাধারণভাবে বম জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের ওপর বিপর্যয় নেমে এসেছে।
তখন ভাসমান যৌনকর্মীদের নিগ্রহের খবর নিয়ে পীড়িত ও ব্যস্ত ছিলাম। বমদের কথা মনের পেছনের তাকে ঠেলে দিয়েছিলাম। আজকে আমার মনটা আতশি কাচের নিচে ফেলতে আরও অনেক কথার মধ্যে এ দুটি প্রসঙ্গও চোখের সামনে উঠে এল।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা সাংবাদিক
[email protected]