বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন টিসিবির দীর্ঘ লাইন নিয়ে একটির পর একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে। কারা দাঁড়িয়েছিল সেই লাইনে, কী তাদের পরিচয়, ঠিক কী অবস্থায় পড়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল তাদের, সে খবরও দিয়েছিল প্রথম আলো। বহু মানুষ ছিল, যারা জীবনে প্রথমবারের মতো দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল এ লাইনে। আসলে করোনার তীব্র অভিঘাত শ্রেণিকাঠামোই পাল্টে দিয়েছিল আমূল। আর তাই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে হঠাৎ দরিদ্র হয়ে পড়া মানুষগুলো বুঝতে পারছিল না, ঠিক কী করে সামাল দেবে পরিস্থিতি। কারও চাকরি গেছে, কেউ কাজ হারিয়েছে, কেউবা বাধ্য হয়েছে এই শহরটাই ছাড়তে। সামাল দেওয়ার লড়াইয়ে তাই পঙ্গু, অসহায় মানুষ যেমন ছিল, তেমনি ছিল বয়সের ভারে ন্যুব্জ বৃদ্ধ কিংবা ছোট্ট শিশু।
এমনকি টিসিবির ট্রাকের নিচে পড়ে যাওয়া চাল কুড়িয়ে জমা করেছিল ছোট্ট শিশু, মাকে সাহায্য করবে বলে। শিশু আরিয়ান গিয়েছিল শাক কুড়াতে, যাতে অসুস্থ মায়ের ভার কিছুটা হলেও লাঘব করা যায়। সরকারি কোনো পরিসংখ্যান না হলেও গবেষণা সংস্থা সানেম সেই ২০২০ সালেই বলেছিল, ৪২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ব্র্যাক-পিপিআরসিও একই ধরনের হিসাব দিয়েছিল। কিন্তু সরকার ছিল অনড়।
করোনার এ ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাতারাতি আকাশ ছুঁল জ্বালানি তেলের দাম। সরবরাহ চেইন তো আগেই ভেঙেছিল; সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম যুক্ত হয়ে বিশ্বকে যেন স্থবির করে দিল। বাংলাদেশের সরকার তাই বারবারই বলার চেষ্টা করছে, আজকের এই অর্থনৈতিক ধাক্কা অতিমারি আর যুদ্ধের ফলাফল। সন্দেহ নেই, করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনৈতিক মন্দাকে ত্বরান্বিত করেছে, কিন্তু দীর্ঘদিনের সরকারের যে পুঞ্জীভূত ‘পাপ’, তার ফলাফল ভোগ করতেই হতো আমাদের।
বীভৎস দুর্নীতি, লুটপাট, তথ্য গোপন, জবাবদিহিহীনতা, গণতন্ত্রের নামে কার্যত এক ব্যক্তির শাসন জারি রাখা, সর্বক্ষেত্রে সরকারের স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, ঋণের টাকায় ঘি খাওয়ার প্রবণতা আর গোষ্ঠীতন্ত্রের মাশুল দিতেই হতো আমাদের। যেমন দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। আইএমএফের তথ্য বলছে, বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হতে পারে, বিশেষত যেখানে ঋণের মাত্রা উচ্চ এবং নীতিমালার পরিসর সীমিত। আইএমএফের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিবিসির তৈরি করা রিপোর্ট বলছে, শ্রীলঙ্কা হওয়ার তালিকায় যেসব দেশের নাম আসতে পারে, বাংলাদেশ তার একটি।
এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও একই পরিমাণ পাউরুটির দাম ৫০ টাকা, যা বাংলাদেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। পাউরুটির একটি রূপ বনরুটি খায় একেবারেই খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ। নাশতা তো বটেই, দুপুরের খাবারের খরচ আর ঝামেলা কমানোর জন্য অনেক দরিদ্র মানুষ কাজের ফাঁকে কলা বা চা দিয়ে বনরুটি খায় দীর্ঘকাল থেকেই। এ দেশের দরিদ্র মানুষ মুদ্রার চরম পতন হয়ে যাওয়া দেউলিয়া শ্রীলঙ্কার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি দামে ন্যূনতম খাবার কিনছে—দেশের পরিস্থিতি বোঝাতে এর চেয়ে বেশি কোনো তথ্যের দরকার আছে বলে মনে করি না।
কিছুদিন যাবৎ ‘দুর্ভিক্ষ’ শব্দটি বড় বেশি যেন শুনছি, তা-ও আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। বিশ্ব খাদ্য দিবসে আবারও খাবার অপচয় বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, বেঁচে যাওয়া খাবার সংরক্ষণ করে আমরা যেন পুনর্ব্যবহার করি। এর আগে তিনি এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি না রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অফিস কিংবা বাড়ির ছাদে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে, সরকারিসহ অন্যান্য অফিসের মাঠসহ এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে তিনি কোনো না কোনো কিছু ফলাতে নির্দেশনা দেননি। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য এটুকু তথ্যই যথেষ্ট।
এ সরকারের অসংখ্য অসত্য প্রচারণার মধ্যে অন্যতম একটি হলো বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ প্রচার সরকার দীর্ঘদিন ধরে করে এসেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশকে গত অর্থবছরে এক কোটি টনের বেশি খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে। এই তথ্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার। কৃষিমন্ত্রী স্বয়ং বলছেন, দেশে প্রতিবছর শুধু ভোজ্যতেল আমদানিতে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এমনকি দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠা গমও আমদানি করতে হয় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। বলে রাখি, গত ১২ বছরে দেশে খাদ্য আমদানি কমা দূরেই থাকুক, বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ যদি নেওয়া হতো, তাহলে এ পরিস্থিতি হয় না। সরকার মাথাপিছু আয় কিংবা রিজার্ভ বেড়ে যাওয়ার স্বপ্নে এতটাই বিভোর ছিল যে খাদ্যশস্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের দিকে মনোযোগ দিতে পারেনি। এর মাশুল হিসেবে অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতার ফলাফল এখন দেখতে পাচ্ছি আমরা।
সব দোষ নন্দ ঘোষ—এ ফর্মুলায় বিশ্বাসী সরকার এখন যেকোনো সংকটের জন্য সরাসরি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে। যুদ্ধের কাঁধে সব দায় চাপানোর আগে একটু দেখে আসি এ দেশের সাধারণ মানুষের কেমন ছিল যুদ্ধ এমনকি করোনা শুরুরও অনেক আগে। ‘এখনো অভুক্ত মানুষ, নিশ্চিত হয়নি খাদ্যনিরাপত্তা’ শিরোনামে ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন আমাদের সামনে উন্মোচিত করে অবিশ্বাস্য তথ্য। ‘সারা দিনে এক বেলাও খেতে পায়নি প্রায় ৩ শতাংশ শহুরে দরিদ্র পরিবার; শহরের ৮ শতাংশ দরিদ্র পরিবার না খেয়ে ঘুমাতে যায়; শহরের ১২ শতাংশ দরিদ্র পরিবারে খাবার নেই; শহরের ২১ শতাংশেরও বেশি দরিদ্র পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার নেই; ৭ শতাংশ পরিবার কম পরিমাণে খাবার খাচ্ছে’—প্রতিবেদনে থাকা এসব তথ্যের সঙ্গে প্রদিবেদন প্রকাশিত হওয়ার তারিখ মিলিয়ে দেখলে মনে হতেই পারে, করোনার সময় মানুষের এমন সংকট হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু মজাটা হলো জরিপটি পরিচালিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত, অর্থাৎ করোনার আগে। সে সময়ই সাধারণ দরিদ্র মানুষ এমন চরম সংকটে ছিল। ক্ষমতাসীন সরকার তার বিরুদ্ধে যায়—এমন সব পরিসংখ্যান নাকচ করে দেয় এককথায়। কিন্তু ‘দ্য আরবান স্যোশিওইকোনমিক অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে (ইউএসএএস) ২০১৯’ শিরোনামের এ জরিপ করেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাই প্রশ্ন করি, সরকারের যে অর্থমন্ত্রী সানেম বা ব্র্যাক-পিপিআরসির করোনার সময়ের দারিদ্র্য নিয়ে করা জরিপ খারিজ করে দেন, তিনি এ জরিপ নিয়ে কী বলবেন?
এরপর তো পাল্টে গেল পুরো চিত্রই। করোনার আগেই অভাব, দারিদ্র্য আর মূল্যস্ফীতির চাপে ধুঁকতে থাকা মানুষের কাতারে শামিল হলো আরও অসংখ্য মানুষ। সরকারি তথ্যই বলছে, মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের বেশি। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১৮ কোটি মানুষের দেশে ১২ কোটি ২৫ লাখ মানুষ খাবার কিনতে স্রেফ হিমশিম খাচ্ছে। করোনার প্রকোপ শেষ হয়েছে প্রায় বছর হতে চলল। কিন্তু মানুষের অবস্থা ভালো হওয়া দূরেই থাকুক, কেবল খাবার জোগাড়ে ঋণ করতে বা সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে মানুষকে। এ বছরের আগস্ট মাসে পরিবারের খাদ্য কেনার জন্য ৬৪ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছে। ২৯ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙেছে। আবার খাবার কিনতে গিয়ে ১০ শতাংশ পরিবার তাদের গত ১২ মাসের সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে। মানুষের অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকলে খাবার কিনতে ঋণ বা সঞ্চয় ভাঙার মতো পদক্ষেপ নিতে হয়, সেটি বোঝা খুব কঠিন কিছু নয়।
সম্প্রতি গবেষণা সংস্থা সিপিডির এক সংবাদ সম্মেলনে উঠে এসেছে ভয়াবহ আরেক তথ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আমাদের দেশের গরুর মাংসের দাম এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। কতটা বেশি, তা বোঝার জন্য আশা করি এটুকু তথ্যই যথেষ্ট যে আমাদের দেশে এক কেজি গরুর মাংসের দাম পাকিস্তানের দ্বিগুণ। গরুর মাংস যেহেতু এখন অনেকটাই বিলাসী খাদ্যে পরিণত হয়েছে, তাই এ আলোচনা সরিয়ে রেখে আমরা একটু তাকাই একেবারে অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের দিকে। বাংলাদেশে আধা কেজি পাউরুটির দাম ৬২ টাকা, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। আধা কেজি পাউরুটির দাম পাকিস্তানে ৪৫ টাকা; ভারত ও নেপালে ৪৮ টাকা।
এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও একই পরিমাণ পাউরুটির দাম ৫০ টাকা, যা বাংলাদেশের তুলনায় যথেষ্ট কম। পাউরুটির একটি রূপ বনরুটি খায় একেবারেই খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ। নাশতা তো বটেই, দুপুরের খাবারের খরচ আর ঝামেলা কমানোর জন্য অনেক দরিদ্র মানুষ কাজের ফাঁকে কলা বা চা দিয়ে বনরুটি খায় দীর্ঘকাল থেকেই। এ দেশের দরিদ্র মানুষ মুদ্রার চরম পতন হয়ে যাওয়া দেউলিয়া শ্রীলঙ্কার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি দামে ন্যূনতম খাবার কিনছে—দেশের পরিস্থিতি বোঝাতে এর চেয়ে বেশি কোনো তথ্যের দরকার আছে বলে মনে করি না।
সরকার যখন উন্নয়নের মহাসড়ক কিংবা মাথাপিছু আয়ের গল্পে বিভোর ছিল, শোনাচ্ছিল রিজার্ভ বা মেট্রোরেলের কাহিনি, সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা যখন টুকরিতে করে বিদ্যুৎ ফেরিতে ব্যস্ত ছিলেন, তখনই সবার অলক্ষ্যে থাকা সরকারি জরিপ বলছিল, মানুষ ভালো নেই। ন্যূনতম চাহিদা খাওয়ার কষ্টে আছে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ। এরপর তো পাল্টে গেল সবকিছুই। ডলারের দাম হলো আকাশচুম্বী, চল্লিশের ঘরে থাকা রিজার্ভ নেমে দাঁড়াল কুড়ির ঘরে, সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি পৌঁছাল প্রায় দুই অঙ্কে, জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ল পরিবহন থেকে পণ্য সবকিছুর দাম আর শেষমেশ সরকার স্বীকার করল দুর্ভিক্ষ আসছে। যে ৪২ দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে, বাংলাদেশ তার একটি। উন্নয়নের মহাসড়কে তীব্র বেগে ধাবমান সরকারের ফুরসত হয়নি সাধারণ মানুষের ঘরে কান পাতার। না হলে বুঝত নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে বহুদিন হলো।
রুমিন ফারহানা বিএনপির সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী