সব মানুষের জন্য একটি উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষাই নারীবাদী চেতনার মূল কথা। পাঠক, লক্ষ করুন, বলা হয়েছে ‘সব মানুষ’—শুধু নারী নয়, শুধু পুরুষও নয়। সব মানুষের জন্য একটি উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে নিশ্চিত করতে হবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমতা ও সুষম বণ্টন। বস্তুত নারীবাদী চেতনার ভিত্তি হলো মানবতা। এই চেতনার বাইরে যেসব কথাবার্তা—সবই নারীবাদের অপভ্রংশ।
নারীবাদের উদ্দেশ্য হলো, এককথায়, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সমতা।
তিনিই নারীবাদী যিনি বিশ্বাস করেন, শুধু লিঙ্গের কারণে নারী বৈষম্যের শিকার, নারী হওয়ার কারণে তাঁর ন্যায্য পাওনা সমাজ দিতে অস্বীকার করে এবং এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সমাজের মধ্যে আমূল পরিবর্তন তথা বিপ্লব দরকার।
জগতের ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমতায় বিশ্বাস করেন না—এমন মানুষ নারীবাদী হতে পারেন না। এই সমতা কোথায়, কোনখানে? এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে, এক লিঙ্গ থেকে আরেক লিঙ্গ, এক সম্প্রদায় থেকে আরেক সম্প্রদায়ে, ধনী থেকে গরিবে, অভিজাত থেকে প্রাকৃতজনে, এক জাতিগোষ্ঠী থেকে আরেক জাতিগোষ্ঠীতে, সাদা-কালোয়, অবয়বে, ক্ষর্বকায়ে-দীর্ঘকায়ে—সর্বত্র। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য কালো, খর্বকায়, ছোট লোক ইত্যাদি অভিধা ব্যবহার করত। মধ্যপ্রাচ্যের লোকেরা পেট্রোডলারের অহংকারে গরিব দেশ থেকে আসা শ্রমিকদের মিসকিন বলে অভিহিত করত। এই দুই ক্ষেত্রেই তাঁরা আবার ইউরোপ-আমেরিকার শ্বেতকায় নাগরিকদের সমীহ ও সম্মান করে কথা বলত। কারণ, তাঁরা ধনী ও উন্নত দেশের নাগরিক। একজন নারীবাদী এমন বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারেন না। যদিও এই বৈষম্য লৈঙ্গিক নয়। সর্বক্ষেত্রে সমতায় বিশ্বাস অর্থাৎ হোলিস্টিক তথা সামগ্রিক ও সামষ্টিক অর্থে সমতাবাদী না হলে একজন মানুষের পক্ষে নারীবাদী হওয়া সম্ভব নয়। অফিসপাড়ায় বা ভদ্রলোকের সমাজে একজন নারীর প্রতি সহিংসতায় একজন নারীবাদী মানুষ যেমন প্রতিবাদমুখী হবেন, একজন পুরুষ শ্রমিকের প্রতি মালিকপক্ষের অন্যায় আচরণেও তিনি সমানভাবে প্রতিবাদমুখী হবেন। যদি না হন, তবে তিনি প্রকৃত নারীবাদী নন।
নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব যেমন অন্যায্য। তেমনি পুরুষের ওপর নারীর কর্তৃত্বের আকাঙ্ক্ষাও নারীবাদী চেতনার পরিপন্থী। কারণ, এ রকম আকাঙ্ক্ষা সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা স্থাপনের প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে। তবে পুরুষের ওপর নারীর কর্তৃত্বের আকাঙ্ক্ষাকে পুরুষ কর্তৃক নারীর ওপর সহস্র বছরের নিপীড়নের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দেখতে হবে এবং এমন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের পরও তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকতে হবে।
নারীর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকার মানুষের অধিকারেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ এবং একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সমাজে যদি শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, শ্রমিক তাঁর ন্যায্য পাওনা পান, নারীর অধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই কথাটা বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি প্রযোজ্য। কারণ পোশাকশিল্পে, গৃহকর্মে, এমনকি কৃষি ও অকৃষি খাতেও সর্বত্র নারীর উপস্থিতি। অতীতের নারী আন্দোলন থেকে বর্তমান সময়ের নারীদের শিক্ষা নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশে জন্য নারীবাদ ইস্যুটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কারিগর নারী। শুধু পোশাকশিল্পেই নয়, কৃষি ও অকৃষি খাতে, গৃহকর্মে ক্রমবর্ধমান হারে নারীর কর্মে নিযুক্তি বাংলাদেশে এই উন্নয়ন এনে দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নই নারীবাদের মূলকথা কিন্তু এ দেশে কি নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে? সোজাসাপ্টা কথা: না, এ দেশে নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি। এ বিষয়ে আপাতত দুটি সূচকের কথা বলি। এক নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরি বৈষম্য, দুই পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। বস্তুত, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাই ক্ষমতায়নের মাপকাঠি। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে।
আধুনিক রাষ্ট্রের আধুনিক সমাজে নারীবাদী চেতনা বিস্তৃত। নীতিগতভাবে নারী-পুরুষের সমতা স্থাপনের প্রয়াস হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এখনো এমনটা ঘটেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো আধুনিক দেশেও একই কাজ করেন পুরুষের চেয়ে নারীরা, শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গরা কম মাইনে পান, যার প্রতিফলন ঘটেছে করোনা মহামারির সময়ে। দেখা গেল, মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের, পুরুষের চেয়ে নারীর অনেক বেশি কারণ বছরের পর বছর কৃষ্ণাঙ্গরা, নারীরা ক্যালরি-স্বল্পতায় ভোগার ফলে তাঁদের দেহে রোগপ্রতিরোধব্যবস্থা দুর্বল। উন্নত দেশগুলোতে হলিউড, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সহকর্মী বা উচ্চপদস্থদের দ্বারা, শিক্ষকদের দ্বারা নারীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনা আজও ঘটে যাচ্ছে। যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ নারী অবমাননার চূড়ান্ত রূপ। পুরুষ নারীকে এভাবে অবমাননা করার মানে হলো, নারীকে তারা অধস্তন মনে করে, দুর্বল ভাবে, ধরে নেয় শ্লীলতাহানি নারীরা মেনে নেবে অথবা বিচার চাইলেও বিচার হবে না। বিষয়টি আরও একটু পরিষ্কার করে বলি: ভুক্তভোগী নারী যাঁদের কাছে বিচার চাইবে, তাঁরা নিজেরাও এই কাজ করেন। ‘বিচার না হওয়ার কারণ বিচার করার মালিকেরাও যৌন হয়রানির দোষে দুষ্ট’—স্লোগানটা সমাজের প্রতিটি কোণ থেকে উচ্চ স্বরে ওঠা উচিত।
নারীর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকার মানুষের অধিকারেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ এবং একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সমাজে যদি শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়, শ্রমিক তাঁর ন্যায্য পাওনা পান, নারীর অধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এই কথাটা বাংলাদেশের জন্য খুব বেশি প্রযোজ্য। কারণ পোশাকশিল্পে, গৃহকর্মে, এমনকি কৃষি ও অকৃষি খাতেও সর্বত্র নারীর উপস্থিতি।
অতীতের নারী আন্দোলন থেকে বর্তমান সময়ের নারীদের শিক্ষা নেওয়া দরকার।
শিক্ষাটা হলো, হলিস্টিক তথা সর্বাত্মক আন্দোলনের শিক্ষা। জার্মানির ক্লারা জেটকিন, ব্রিটিশ নেত্রী এমেলিন পেট্রিক-লরেন্স, ব্রিটিশ শান্তিবাদী আন্দোলনের নেত্রী হেলেনা সনউইক, কার্ল মার্ক্সের কন্যা ইলিয়নোর মার্ক্স, লেনিনের জীবনসঙ্গিনী নাদেঝদা ক্রুপস্কয়া—সবাই যুক্ত থেকেছেন সমাজের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার, মনজাগতিক পরিবর্তনের সর্বাত্মক আন্দোলনের, বিপ্লবের। যে আন্দোলনে নারী, পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে শুধু নারীর জন্য নয়—সবার জন্য।
আমি পুরুষ। আমি কেন নারীর অধিকারের জন্য যুদ্ধ করব? নীতি-আদর্শের কথা যদি বাদও দিই, আমার নিজের স্বার্থেই নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে আমার দাঁড়ানো দরকার। একটি দেশের মোটামুটি ৫০ শতাংশই নারী থাকেন। ক্ষমতায়নের একটি প্রধান উপাদান হলো, লেবারফোর্স পার্টিসিপেশন তথা কর্মে নিযুক্তি। এই হার যত বেশি হবে, দেশের উৎপাদন তত বেশি হবে। নিজের পরিবারের স্ত্রী, কন্যা বা ভগ্নির কর্মে নিযুক্তি থেকে সরাসরি যে উপকার আসবে, তার বাইরে, রাষ্ট্রের নিট লাভ থেকেও আমি উপকৃত হব। তা ছাড়া আমি একটি সমতাভিত্তিক সমাজ চাই, কারণ লৈঙ্গিক বা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার মানুষগুলোর কষ্ট আমার নিজের মধ্যে বেদনা জাগায়, আমার নিজের সুখ বিনষ্ট করে। অমর্ত্য সেনের সুখের ধারণায় যেমন বলা হয়েছে, অন্যকে সুখী দেখার মধ্যেও মানুষ সুখ পায়। আমিও তা-ই পাই। সে জন্যই নারীর অধিকার আদায়ে আমিও যুদ্ধরত। নারী-পুরুষের সম্মিলিত আন্দোলন সম্ভব রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং আন্দোলনটি হতে হবে সাম্যবাদী আন্দোলন কারণ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া, বিচ্ছিন্নভাবে শুধু নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।
বাংলা ভাষার দুই প্রধান আধুনিক কবিই উচ্চকণ্ঠে নারীর জয়গান গেয়েছেন। নজরুলের ‘গাহি সাম্যের গান’ কবিতার সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি আজও আমরা গেয়ে চলি কারণ তাঁর মতো, নারীবাদের জাগরণ কালের কবিরাও, এমন স্পষ্ট উচ্চারণ করতে পারেননি:
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’
আর রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা যখন বলেন:
‘...
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’
নৃত্যনাট্যের এই নায়িকা তখন আদতে নারী-পুরুষের সমতার নীতিই ঘোষণা করেন নির্ভয়ে, সগৌরবে, সবিস্তার। চিত্রাঙ্গদার এমন ঘোষণা নারীকে দেয় প্রেরণা আর পুরুষকে দেয় শিক্ষা।
ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]