এ সপ্তাহের গরম খবর হলো, জাতীয় পতাকা নিয়ে হুজ্জত। জাতির পতাকা থাকে না। পতাকা থাকে রাষ্ট্রের। আমরা সেটাকে জাতীয় পতাকা বলি। কারণ, রাষ্ট্রকেই আমরা জাতি মানি। কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনের যেমন একটা লোগো থাকে, তেমনি রাষ্ট্রের থাকে একটা পতাকা। এই পতাকা নিয়ে আমরা আবেগ তৈরি করি। কখনো ভালোবাসায় ভাসাই, কখনো ঘেন্নায় ডুবাই। সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশে ও ভারতে পতাকা নিয়ে এ রকম ভালোবাসা ও ঘৃণার প্রকাশ দেখলাম।
আমরা অনেক সময় ভয়ে আমাদের ভাবনাগুলো প্রকাশ করি না। না জানি ‘মব’ এটাকে কীভাবে নেবে। দেশে তো এখন চলছে ‘মবোক্রেসি’। কে কখন কার গুষ্টি উদ্ধার করে কিংবা পেটায়, তার নিশ্চয়তা নেই। হঠাৎ একদল লোকের খায়েশ হলো, চলো, আমরা ওখানে গিয়ে গরু জবাই করে মাহফিল করি। মুফতে মাংস-পোলাও পেলে লোক জড়ো হয়ে যায় অনায়াসে।
আমার মনে আছে, একবার শেখ হাসিনার লোকেরা ইস্কাটনে কামাল হোসেনের বাড়ির সামনে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রেখেছিল। সুপ্রিম কোর্টের সামনেও একই কাণ্ড ঘটিয়েছিল। মনে আছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করে খাগড়াছড়িতে এক সমাবেশে একটি গাড়িবহর নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনার বুদ্ধিতে কাঁচপুর সেতুর ওপর আড়াআড়ি করে ট্রাক রেখে দিয়েছিলেন শামীম ওসমানের লোকেরা, যাতে খালেদা জিয়া না যেতে পারেন। সারা দিন তিনি সেখানে অবরুদ্ধ ছিলেন।
শেখ হাসিনার ট্রাকপ্রীতি এরপর আরও বেড়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তিনি একবার খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসার সামনে, আরেকবার গুলশানে বিএনপি অফিসের সামনে বালুবোঝাই ট্রাক দিয়ে রাস্তার বন্ধের বিস্ময়কর রণকৌশল ব্যবহার করেছিলেন। এসব হচ্ছে ‘শত্রু’কে শায়েস্তা করার ফিকির। কীভাবে এর ব্যাখ্যা করবেন? মানুষের আচরণ নির্ভর করে তার রুচি ও শিক্ষাদীক্ষার ওপর। আইন দিয়ে এটি শেখানো যায় না।
এ দেশের মানুষ নানা কারণে ভারতবিরোধী। মূল কারণ দুটি। প্রথমত, এটা হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া। এটা চলছে, চলবে, যত দিন মানুষ তার ধর্মীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেবে। ভারত হয়েছে হিন্দুরাষ্ট্র, বাংলাদেশ হয়েছে মুসলমানের দেশ। তাই অযোধ্যায় মসজিদ ভাঙা হলে এখানে মন্দির ভাঙচুর হয়। এসব কারা করে? আমরা অনেক সময় বলি এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা দাবি করি, এখানে সম্প্রীতির ফুরফুরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে নিরবধি। কতিপয় দুষ্কৃতকারী এসব হীন কাজ করে আমাদের মধ্যকার সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়। সমস্যা হলো বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো নিয়মিত ঘটছে। যারা ঘটায়, তারা বলে কেন, ইন্ডিয়া তো এটা করেছে।
বাংলাদেশে ইসকন ইস্যুতে আবহাওয়া বেশ গরম। এক হিন্দু ধর্মগুরু রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। ভারতে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে জাতিসংঘের তদারকি বাহিনী পাঠানোর আবদার করেছেন। মমতা এত দিন পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করছেন ‘মুসলিম ভোটব্যাংক’ ব্যবহার করে। তিনি রোজা রাখেন, কোরবানি দেন, খাজাবাবার মাজার জিয়ারতের সুবিধার জন্য আজমিরে রেলগাড়ি পাঠান প্রতিদিন। এদিকে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের বড় ‘হিন্দু ভোটব্যাংক’ কবজা করে তাদের শক্তি বাড়াচ্ছে। বড় ব্যাংকটি না আবার একেবারে হাতছাড়া হয়ে যায়, এ নিয়ে মমতার কপালে ভাঁজ পড়েছে। তাই তিনি হঠাৎ করেই ‘হিন্দু’ হয়ে গেলেন। এদিকে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী ভারতে বাংলাদেশের দূতাবাস রক্ষা করতে জাতিসংঘের বাহিনী চেয়েছেন।
হাওয়া দেখে পল্টি খাওয়া রাজনীতিবিদদের বলা হয় ‘ডেমাগগ’ বা গলাবাজ। মমতাও তা–ই। আর কে না জানে, আমাদের এ অঞ্চলে নেতা নেই বললেই চলে। কেবল ডেমাগগের ছড়াছড়ি। মাঠ কে কত গরম রাখতে পারেন, এখন চলছে তার প্রতিযোগিতা। তা ছাড়া নজর কাড়ার ব্যাপারও আছে। সব মিলিয়ে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।
একটি জনগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের পতাকা অনেক আদরের, মর্যাদার, ভালোবাসার ধন। কিন্তু সেটি যদি হয় ‘শত্রুরাষ্ট্রের’, তাহলে ওই পতাকা পাপোশের চেয়ে বেশি কিছু নয়। পতাকা নিয়ে ঘৃণার চাষ হচ্ছে এখন। বাংলাদেশ আর ভারত নাকি কয়েক দিন আগে বন্ধুত্বের চরম সীমায় পৌঁছেছিল। এখন কি তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেল?
যুদ্ধ তো ভালো নয়। যুদ্ধ মানেই হত্যা, ধ্বংস, ক্ষয়। একাত্তরের মার্চে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো’ বলে যাঁরা রাজপথে বুলন্দ আওয়াজ তুলেছিলেন, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর তাঁদের অনেকেই দেশের সাত কোটি মানুষকে বিপদের মধ্যে ফেলে সবার আগে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। যুদ্ধ যাঁরা চান, তাঁরা যুদ্ধ করেন না। তবে যুদ্ধের ফসল পকেটে পুরতে তাঁরা সবার আগে হাজির হন। এটা তো আমাদের চোখের সামনেই দেখা।
একটা নিরুপদ্রব জনপদে অশান্তি তৈরি করে সেটি ছারখার করে দেওয়ার লোক আছে অনেক। সেই যে একজন বাঁশের বেড়ায় এক চিমটি গুড় মেখে দিয়েছিল, তার ফলে কী তুলকালাম হলো, সে গল্পটা আমরা জানি। বুয়েটের কোনো এক জায়গায় কে বা কারা ভারতের একটা পতাকা রেখে দিয়েছিল, যাতে অন্যরা সেটা মাড়িয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়া হলো কলকাতায়, আগরতলায়। সেখানে বাংলাদেশ মিশন আক্রান্ত হলো, বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা হলো।
একটি জনগোষ্ঠীর কাছে নিজেদের পতাকা অনেক আদরের, মর্যাদার, ভালোবাসার ধন। কিন্তু সেটি যদি হয় ‘শত্রুরাষ্ট্রের’, তাহলে ওই পতাকা পাপোশের চেয়ে বেশি কিছু নয়। পতাকা নিয়ে ঘৃণার চাষ হচ্ছে এখন। বাংলাদেশ আর ভারত নাকি কয়েক দিন আগে বন্ধুত্বের চরম সীমায় পৌঁছেছিল। এখন কি তারা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেল?
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কখনোই সরলরেখায় চলেনি। কখনো ভালো, কখনো মন্দ। কখনো গলাগলি, কখনো আড়াআড়ি। একটি ছোট ও দুর্বল প্রতিবেশীর সঙ্গে কীভাবে শান্তিতে সহাবস্থান করতে হয়, ভারত সেটি শেখেনি। একটি বড় ও শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে কীভাবে সমমর্যাদা নিয়ে টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করতে হয়, এটি বাংলাদেশ শেখেনি।
এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ শান্তিপ্রিয়। কিছু লোক এটা চায় না। ঝগড়াঝাঁটি ছাড়া তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। তারা সব সময় ফন্দি আঁটে, উসকানি দেয়, গোলমাল বাঁধায়। জাতীয় পতাকাকে মাড়িয়ে যাওয়ার বুদ্ধি কার মাথায় প্রথম এসেছিল, জানি না। কিন্তু এর ফলে অর্জন কী হলো? উগ্র রাষ্ট্রবাদকে উসকে দেওয়া হলো। এর সঙ্গে দেশপ্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই।
দেশপ্রেম একটা বায়বীয় বিষয়। যেখানে মানুষের কল্যাণ নেই, সেই দেশপ্রেমের দরকার কী? আরেক দিকে আছে ধর্মান্ধতা। ধর্মান্ধতার সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগ নেই। উগ্র রাষ্ট্রবাদ আর ধর্মান্ধতা মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। আমাদের এই অঞ্চলে অনেক বছর ধরেই উগ্র রাষ্ট্রবাদ আর ধর্মান্ধতার নিবিড় চাষ হচ্ছে। এর ফলে লাভবান হচ্ছে একশ্রেণির রাজনৈতিক ফড়িয়া। তাদের তরক্কি বাড়ছে তরতর করে।
ধর্ম এ অঞ্চলের মানুষের রক্তে, অস্থিতে, মজ্জায় মিশে আছে। ধর্মকে অবজ্ঞা করে এ দেশে কারও পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। এ জন্যই এ দেশে কমিউনিস্ট রাজনীতি কল্কে পায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট বিপ্লব প্লাটিনাম জুবিলি পেরিয়েও ধর্মের পুনরুত্থান রোধ করতে পারেনি। এটাই বাস্তবতা। তাই বলে সরলপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে রাজনৈতিক মতলব হাসিলের ধান্দা থেমে নেই। দিন দিন এটা বাড়ছে।
কেউ কেউ শাস্ত্র ঘেঁটে বলবেন, এটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি অসুখ। কিন্তু এ দেশের মানুষ তো পুঁজিবাদ-সমাজবাদ কোনোটাই বোঝে না! আর যাঁরা বোঝেন বলে দাবি করেন, তাঁরাই–বা কতটুকু বোঝেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। এক শ বছর ধরে তো একই গীত শুনে আসছি। ‘প্রগতিশীলের’ সংখ্যা তো বাড়ছে না। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মাত্রা বাড়ছে দিন দিন। আমরা একটা গভীর অসুখের মধ্যে পড়েছি। কিন্তু যাত্রাদলের ‘বিবেকের’ মতো এসব কথা বলে লাভ কী। কে শোনে? দেশ যাচ্ছে ক্রমাগত খাদের কিনারায়। অন্যদিকে অনেকেই নিরাপদ দূরত্বে থেকে ডুগডুগি বাজাচ্ছে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক