ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর বাইরের যেকোনো দেশের যে কাউকে যদি আপনি বলেন এখন বিশ্বের কয়েক শ কোটি মানুষ বিশ্বকাপ–জ্বরে কাঁপছে, তাহলে সম্ভবত তার কাছ থেকে আপনি বিভ্রান্তিসূচক অভিব্যক্তি পাবেন।
বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের কাছে বিশ্বকাপের মানে হলো বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট, যা কিনা গত বছর কাতারে হয়ে গেছে এবং উত্তর আমেরিকায় ২০২৬ সালের আগে হবে না। তবে বাকি বিশ্বের কাছে, বিশেষ করে উপমহাদেশের ২০০ কোটি মানুষের কাছে বর্তমানে ভারতে চলমান পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপই হলো আসল বিশ্বকাপ।
২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত গত বিশ্বকাপের দুই ফাইনাল প্রতিযোগীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়ে ৫ অক্টোবর এবারের বিশ্বকাপের শুরু হয়। সে বছর পরাজিত হওয়া নিউজিল্যান্ড এ বছর আহমেদাবাদে প্রধানমন্ত্রীর নামে বানানো নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের ওপর চরম প্রতিশোধ নিয়েছে।
এই আহমেদাবাদকে ভারতের নতুন ক্রিকেট রাজধানী হিসেবে দেখা হচ্ছে। আগামী ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় ফাইনাল খেলা দেখতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে হাজির থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে তৃতীয় মেয়াদে নিজের ও নিজ দল বিজেপির জয় নিশ্চিত করতে মোদি অনেক রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। ফাইনাল খেলার অনুষ্ঠানটিকে সর্বোচ্চ জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলার যে আয়োজন চলছে, সেটিও সেই পরিকল্পনার অংশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত আগস্টে চাঁদে ভারতের নভোযানের সফল অবতরণ ও গত সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে সফলভাবে জি-২০ সম্মেলন অনুষ্ঠান করার পর জাতীয় জাগরণে মোদির বড় ভূমিকা থাকার কথা বারবার সামনে আসছে। তবে এই বিশ্বকাপ ফাইনালে যদি ভারত জয় পায়, তাহলে সেই অর্জনের আলাপ বিশ্বকাপ জয়ের উল্লাসে কিছুটা হলেও ঢাকা পড়ে যেতে পারে।
কয়েক দশক ধরে ভারতের রাজনীতিকেরা এই বিষয়টি আমলে নিয়ে আসছেন যে ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকাটা ভোটারদের মন জয় করা সহজ করে। সে কারণে ভারতীয় রাজনীতি ও ক্রিকেট আমলাতন্ত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
এই বিশ্বকাপে যদি ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে সন্দেহাতীতভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদির মুকুটে আরও একটি বিজয়-পালক যুক্ত হবে। এটিকে ভারতের উত্থানের একটি ধাপ হিসেবেও প্রচার করা হবে। আর ভারতের পরাজয় হলে ভারতীয় দলে ১৫ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে যে দুজন মুসলমান আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের অভাব থাকার অভিযোগ নেমে আসবে।
ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) প্রভাবশালী সেক্রেটারি জয় শাহ ভারতের দ্বিতীয় প্রধান শক্তিধর নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে। এর আগে দিল্লির শীর্ষ ক্রিকেট প্রশাসক ছিলেন মোদির প্রয়াত অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। জেটলির মৃত্যুর পর রাজধানীর প্রধান ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নাম তাঁর নামেই রাখা হয়। মোদি তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাটের ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হিসেবে দীর্ঘদিন থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।
ভোটের হিসাব–নিকাশের বাইরেও ক্রিকেটের সঙ্গে প্রচুর অর্থকড়ি ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব–প্রতিপত্তির ব্যাপারস্যাপার রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ক্রিকেট খেলাকে ঘিরে বিশ্বে যত রাজস্ব আয় হয়ে থাকে, তার ৯০ শতাংশ ভারতের দখলে থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৭ কোটি ১০ লাখ ডলার আয় করা বিসিসিআই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট সংস্থা।
বিশ্ব ক্রিকেটে ২০ ওভারের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিপ্লবের অগ্রদূতও ভারত। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরের ক্রিকেটের দর্শক পূর্ণাঙ্গ পরিসরের ক্রিকেটের চেয়েও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। টি-টোয়েন্টি এখন ক্রিকেটের মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক ধরন। জনপ্রিয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) কোটি কোটি ডলারের চুক্তিতে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের এই লিগে আকৃষ্ট করে থাকে। ভারতের বিশাল সংখ্যক টেলিভিশন দর্শকের মনোযোগ কাড়ায় লাভজনক স্পনসরশিপের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আইপিএলে গত পাঁচ বছরে বিসিসিআইয়ের খেলোয়াড়দের সঙ্গে চুক্তি করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৬২০ কোটি ডলার।
বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের শেয়ারবাজার চাঙা হতে শুরু করেছে। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার তিন মাস আগেই ভারতের শেয়ারবাজারের সূচক ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। ভারতের যে শহরগুলোতে খেলার ভেন্যু পড়েছে, খেলার তারিখে সেই শহরগামী বিমানের ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আহমেদাবাদগামী বিমানের টিকিটের দাম ৪১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সবাই বলছে, এই বিশ্বকাপ ভারতের অর্থনীতিতে প্রায় ২৬০ কোটি ডলার যোগ করবে।
বিসিসিআই ভারতের স্বার্থ রক্ষার দিকটি মাথায় রেখে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময়সূচি নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে আইপিএল কখন হবে, না হবে তা বিসিসিআই একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন সব খেলোয়াড়কে হাতের নাগালে পাওয়া যায়, ঠিক সেই সময়টাতেই আইপিএলের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, খেলার নিয়মকানুন ঠিক করা এবং বিশ্বব্যাপী ক্রিকেট রাজস্ব বণ্টনের বিষয়ে বিসিসিআই বড় ধরনের ভূমিকা রাখে বলে জনমনে পোক্ত ধারণা আছে। আইসিসির সাম্প্রতিকতম ৩০০ কোটি ডলারের সম্প্রচারস্বত্বের ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ পাবে ভারত।
ভারত যখন এই বছরের এশিয়া কাপে অংশগ্রহণের জন্য তার খেলোয়াড়দের পাকিস্তানে পাঠাতে রাজি হলো না, তখন পাকিস্তানের সামনে ভারতের ক্রিকেট বোর্ডের দাবি অনুযায়ী এশিয়া কাপের বেশির ভাগ ম্যাচ শ্রীলঙ্কায় স্থানান্তরের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা ছিল না। পাকিস্তান এই টুর্নামেন্টের আয়োজক দেশ ছিল, তবে তা ছিল নামমাত্র।
২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে পাকিস্তানের সন্ত্রাসীরা হামলা চালানোর পর থেকে ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেট সম্পর্ক কার্যত থমকে আছে। যদিও ২০১২-১৩ সালে ভারতে দুই দেশের মধ্যে একটি একটি সিরিজ হয়েছিল। এরপর থেকে ভারত তার খেলোয়াড়দের পাকিস্তানে পাঠাতে অটলভাবে অস্বীকার করে আসছে।
এই বিশ্বকাপে যদি ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়, তাহলে সন্দেহাতীতভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদির মুকুটে আরও একটি বিজয়-পালক যুক্ত হবে। এটিকে ভারতের উত্থানের একটি ধাপ হিসেবেও প্রচার করা হবে। আর ভারতের পরাজয় হলে ভারতীয় দলে ১৫ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে যে দুজন মুসলমান আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের অভাব থাকার অভিযোগ নেমে আসবে।
এই খেলায় আরও যুক্ত থাকছে বাজি। এই ভূভারতে ক্রিকেট যতটা না খেলা, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক হাতিয়ার; তার চেয়ে বেশি লাভজনক শিল্প, তার চেয়ে বেশি বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং দেশটির কংগ্রেস পার্টির একজন সংসদ সদস্য