ক্যাডার আর নন-ক্যাডার মিলিয়ে পদের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের অনেক কম। অথচ এ জন্য আবেদন করেছেন এর এক শ গুণের বেশি—প্রায় সাড়ে তিন লাখ প্রার্থী। সর্বশেষ ৪৫তম বিসিএসের অবস্থা এই। পদ ও প্রার্থীর অনুপাতই বলে দিচ্ছে, সরকারি চাকরির বাজার ভারসাম্য হারিয়েছে। তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এ সময়ের তরুণদের যেতে হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও যথেষ্ট যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ, যে প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়, তা দিয়ে প্রকৃত মেধা বা দক্ষতা কোনোটাই যাচাই করা সম্ভব নয়। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় এমন সব প্রশ্ন থাকে, যা কেবল মুখস্থ থাকলে পারা যায়।
বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন কেমন হতে পারে, এ নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। আট-দশ বছর আগে প্রাথমিক বাছাই বা প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। আগে ১০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হতো। ৩৫তম বিসিএস থেকে তা বাড়িয়ে ২০০ নম্বর করা হয়। ৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত মূলত ছয়টি বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ, গণিত এবং বিজ্ঞান। ৩৫তম বিসিএস থেকে এগুলোর সঙ্গে যোগ করা হয় ভূগোল পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি, মানসিক দক্ষতা এবং নৈতিকতা মূল্যবোধ ও সুশাসন। প্রশ্নের কাঠামো পরিবর্তন না করে নতুন করে এসব বিষয় কেন যোগ করা হলো, এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফলে এখন যেটি হয়েছে—এসব বিষয়ের কোনো কোনোটি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান না থাকলেও কেবল মুখস্থ করেই প্রার্থীরা উত্তর করতে পারেন।
প্রিলিমিনারি পার হওয়ার উপায় যেহেতু ‘মুখস্থবিদ্যা’, তাই প্রার্থীরা চোখ-কান বুজে গাইডবই মুখস্থ করেন। গাইডের প্রশ্নগুলোও খুব অবিন্যস্তভাবে থাকে; সব প্রশ্ন পড়েও কোনো বিষয় সম্পর্কে সংহত ধারণা পাওয়া যায় না। অর্থাৎ চাকরিপ্রত্যাশীরা কেবল তথ্যই ধারণ করতে থাকেন। একেকজন প্রার্থী বিসিএস পরীক্ষার আগে একেকটি ‘তথ্যভান্ডারে’ পরিণত হন। কিন্তু তথ্য ধারণ করা ছাড়া অন্য যোগ্যতার ঘাটতি মারাত্মকভাবে লক্ষ করা যায় তাঁদের মধ্যে। লিখিত পরীক্ষার বিশ্লেষণমূলক প্রশ্নে বেশির ভাগ প্রার্থীই তথ্য-উপাত্ত ছাড়া আর কিছু লিখতে পারেন না। মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁদের অনুধাবন ক্ষমতা ও চিন্তন দক্ষতাও দুর্বল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা বেশ বুঝতে পারেন, একাডেমিক পড়াশোনা চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। এমনকি বিষয়ভিত্তিক পেশাগত পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্যও বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এই উত্তীর্ণ হওয়া অনেকটা লটারির টিকিট জেতার মতো। কারণ, তিন-চার লাখ প্রার্থীর মধ্যে সেরা ১০ হাজার বা ১৫ হাজারে জায়গা পাওয়া সহজ কথা নয়।
কী ধরনের প্রশ্নে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হচ্ছে, সর্বশেষ ৪৫তম বিসিএসের প্রশ্ন থেকে কিছু নমুনা দেখানো যাক। ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল প্রথম কত সালে অনুষ্ঠিত হয়, চীন-ভারত যুদ্ধ কত সালে সংঘটিত হয়, সিকিম ভারতের সঙ্গে কত সালে যুক্ত হয়, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ কার্যক্রম কত সালে শুরু হয়, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ কত সালে জারি হয়, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ কত সালে গঠিত হয়, ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন কত সালে শুরু হয়, ই-টিন কত সালে চালু হয়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কত সালে প্রবর্তিত হয়, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ কত সালে প্রকাশিত হয়—এ রকম সাল-তারিখ জানতে চেয়ে প্রশ্ন আছে অন্তত ১৫টি। সাল-তারিখের বাইরের প্রশ্নগুলোও প্রায় একই জাতের; অর্থাৎ মুখস্থবিদ্যার ওপর পারা না-পারা নির্ভর করে।
প্রত্যেক প্রিলিমিনারি পরীক্ষার অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ প্রশ্ন হয় মুখস্থনির্ভর। বছরের পর বছর এ ধরনের প্রশ্ন হতে দেখে কোচিং সেন্টারগুলোও বেশ কৌশলী হয়ে উঠেছে। তারা অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত মনে রাখার ‘শর্টকাট’ কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছে। ফলে হাজার হাজার চাকরিপ্রত্যাশী কোচিংমুখী হচ্ছেন। ভাবতে অবাক লাগে, যেসব তথ্য অনলাইনে সার্চ দিয়েই মুহূর্তের মধ্যে জানা সম্ভব, সেগুলো কেন প্রশ্নে রাখতে হয়? প্রশ্ন দেখে মনে হয়, নিয়োগকর্তাদের উদ্দেশ্য ‘তথ্যভান্ডার’ খুঁজে বের করা!
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা বেশ বুঝতে পারেন, একাডেমিক পড়াশোনা চাকরির নিশ্চয়তা দেয় না। এমনকি বিষয়ভিত্তিক পেশাগত পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্যও বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এই উত্তীর্ণ হওয়া অনেকটা লটারির টিকিট জেতার মতো। কারণ, তিন-চার লাখ প্রার্থীর মধ্যে সেরা ১০ হাজার বা ১৫ হাজারে জায়গা পাওয়া সহজ কথা নয়।
বিভিন্ন মহল থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপদ্ধতি বদলের দাবি করা হচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন এমন হওয়া উচিত, যা থেকে প্রার্থীর চিন্তা করতে পারা, বিশ্লেষণ করতে পারা এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারার দক্ষতা যাচাই করা যায়। গত বছর মার্চ মাসে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি কর্মশালার আয়োজন করে। এসব কর্মশালার উদ্দেশ্য ছিল—প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবা এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা। সেসব কর্মশালায় বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নকর্তা ও প্রশ্ন-সমন্বয়কারীদের ডাকা হয়। ওই ঘটনার পর দুটি বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়ে গেল। কিন্তু প্রশ্নে কোনোরকম পরিবর্তন আসেনি। তার মানে কর্মশালাগুলো প্রশ্নপদ্ধতির ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) থাকে। লাখ লাখ আবেদনকারী থেকে সীমিত সংখ্যক প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য এ রকম প্রশ্নের বিকল্প নেই। তবে প্রশ্নের ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। বহু নির্বাচনী প্রশ্নের মাধ্যমেও প্রার্থীর মেধা ও দক্ষতা যাচাই সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তরটি এক শব্দে না হয়ে একটি দীর্ঘ বাক্যে হতে হয়। এ ধরনের দীর্ঘ উত্তর প্রার্থীর বিশ্লেষণ ক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে। এমনকি প্রশ্নটিও দীর্ঘ করা যায়। দীর্ঘ প্রশ্ন প্রার্থীকে চিন্তা করার সুযোগ দেয়। তা ছাড়া একই ধাঁচের প্রশ্নের বদলে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে থাকতে পারে। এমনকি প্রশ্নপত্রে কিছু নমুনা সমস্যা থাকা দরকার, যেখান থেকে প্রার্থীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা যাচাই করা যায়।
বর্তমানে প্রতিটি সঠিক উত্তরের জন্য ১ নম্বর দেওয়া হয় এবং ভুল উত্তরের জন্য ০.৫ কাটা হয়। এমসিকিউ প্রশ্নে আরেকটি দারুণ কার্যকর উপায় আছে, যেটি উত্তর আমেরিকার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রশ্নের চারটি অপশনের মান কখনোই এক রকম হয় না। যেমন কোনো প্রশ্নে হয়তো ‘ক’ উত্তরে +১, ‘খ’ উত্তরে +০.৫, ‘গ’ উত্তরে ০ এবং ‘ঘ’ উত্তরে -০.৫ নির্ধারণ করা হয়েছে। আরেক প্রশ্নে এই মান হতে পারে ‘ক’ উত্তরে +০.২৫, ‘খ’ উত্তরে -১.৫, ‘গ’ উত্তরে +১ এবং ‘ঘ’ উত্তরে -২। তার মানে, প্রশ্নের উত্তরের অপশনটি যতটুকু সঠিক বা যতটুকু ভুল, তার ওপর উত্তরের মান নির্ধারিত হয়। যেহেতু ওএমআর মেশিনে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার খাতা দেখা হয়, সেহেতু এভাবে প্রশ্নের মান নির্ধারণ করেও দ্রুত ফলাফল দেওয়া সম্ভব। মুখস্থনির্ভরতা থেকে বের করে আনার জন্য এবং যোগ্য প্রার্থী নির্ধারণ করার জন্য প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবার বিকল্প নেই।
• তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক