তালেবানের সঙ্গে বিশদভাবে যুক্ত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি পাকিস্তান আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু কেন তারা এ আহ্বান জানাচ্ছে; এর পেছনে ইসলামাবাদের আসল উদ্দেশ্য ও স্বার্থ কী, সেটি এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট। কারণ, পাকিস্তানবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো আফগানিস্তানে অবাধে তৎপরতা চালাচ্ছে এবং পাকিস্তান-তালেবান সম্পর্ক খুবই খারাপ অবস্থায় আছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় বারবার তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সম্পৃক্ততার জন্য যুক্তি দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, আফগানিস্তানে সহায়তা দেওয়া বন্ধ রাখায় দেশটি অর্থনৈতিক পতনের মুখোমুখি হয়েছে। এটি সে দেশের নারীর অধিকার পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাবে এবং মানবিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও একই যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, তালেবানের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার বদলে ব্যাপক সম্পৃক্ততা দরকার। এ ছাড়া তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতাও করা দরকার। তাঁদের বিচ্ছিন্ন বা একঘরে করে রাখার বদলে সমর্থন দিলে তারা অধিকতর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানাবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল জারদারি সম্ভবত আফগানিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান দুর্বল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নতির চেষ্টায় এ প্রস্তাব করেছেন। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান এখনো পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি এবং উভয় পক্ষ থেকে কয়েক মাস ধরে কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের সফর হয়নি। তালেবান ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে আফগানিস্তান বিশ্ব থেকে অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন ছিল। ওই সময় আফগানিস্তানে তালেবানের শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া তিনটি দেশের মধ্যে একটি দেশ ছিল পাকিস্তান। এ কারণে পাকিস্তানে সবার প্রত্যাশা ছিল, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে।
যদিও তালেবানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন ও মধ্য-স্তরের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তবে মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে না দেওয়াসহ একাধিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবানের সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় সম্পর্ক স্থাপন করছে না। তালেবান ক্রমাগত সন্ত্রাসী এবং অ-রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষসুলভ আচরণ বজায় রাখায় যুক্তরাষ্ট্র-তালেবানের দোহা চুক্তির (যে চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে তার ২০ বছরের সামরিক উপস্থিতির অবসান ঘটিয়েছে) একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ভঙ্গ হয়েছে।
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) পাকিস্তানে ঘন ঘন আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ ঘটানোয় তা ইসলামাবাদকে উদ্বেগে ফেলে দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের (ফরেন টেররিস্ট অর্গানাইজেশন, সংক্ষেপে এফটিও) তালিকায় থাকা টিটিপির সঙ্গে তালেবানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সম্ভবত অনেক বছর ধরে চলমান অবস্থার চেয়ে এখন কিছুটা ভালো। গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খানের বিদায় নিঃসন্দেহে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতিতে সাহায্য করেছে। ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি নিয়মিত ট্রাম্প এবং বাইডেন প্রশাসনের প্রকাশ্য সমালোচনা করতেন। এটি দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়তা করেনি।
টিটিপির চার হাজার থেকে সাড়ে ছয় হাজার যোদ্ধা আছে বলে আন্দাজ করা হয়। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে পাকিস্তানে আফগানিস্তান থেকে উদ্ভূত সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এতে যথেষ্ট চাপে পড়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তান চলতি বছরের জুন মাসে তালেবানের মধ্যস্থতায় টিটিপির সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসে। সেই আলোচনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সরকার ও টিটিপির মধ্যে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি হয়; কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে তা ভেঙে যায়।
টিটিপির সঙ্গে বিএলএর সাংগঠনিক যোগসূত্র রয়েছে এবং বিএলএ প্রধানত পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ বেলুচিস্তানে থাকা চীনা নাগরিক এবং চীনা অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে হামলা করে থাকে। ছয় হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে যে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পের কাজ চলছে, সেখানে কর্মরত চীনা শ্রমিকদের সুরক্ষা দিয়ে পাকিস্তান কয়েক হাজার সামরিক কর্মী নিয়োগ করেছে। কিন্তু তারপরও বিএলএর হামলা ঠেকানো যাচ্ছে না।
পাকিস্তান বারবার তালেবানকে আফগানিস্তানে টিটিপি এবং বিএলএর ঘাঁটি বন্ধ করতে বলেছে। তবে তালেবান পাকিস্তানের এ অনুরোধ আমলে নেয়নি। সম্ভবত নেবেও না। বিশেষ করে তালেবানের টিটিপির সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বহুস্তরযুক্ত সংযোগ রয়েছে বলে টিটিপিকে তারা ছাড়তে পারবে না।
তালেবান তাদের পেছনে না লাগার আরেকটি কারণ হলো, তালেবান মনে করে টিটিপিকে ভেঙে দিলে টিটিপির সদস্যরা ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ (আইএসকেপি) নামের চরম উগ্র সন্ত্রাসী গ্রুপে গিয়ে ভিড়তে পারে। আইএসকেপি আফগানিস্তানভিত্তিক একটি বিশেষ আগ্রাসী সংগঠন, যারা ইতিমধ্যে তালেবান এবং টিটিপি থেকে দলত্যাগ করা যোদ্ধাদের নিজেদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে।
তালেবানের সঙ্গে দেনদরবার করার দিক দিয়ে ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের মতপার্থক্য থাকলেও তারা উভয়েই এ বিষয়ে একমত যে টিটিপি, বিএলএ এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী তৎপরতার ‘লঞ্চিং প্যাড’ হিসেবে আফগানিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। গত আগস্টে কাবুলে মার্কিন ড্রোন হামলায় আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে হত্যা করা হয়। মনে করা হয়, হামলাটি হয়েছিল পাকিস্তান থেকে। এতে বোঝা যায়, আল–কায়েদা বা এ ধরনের চেতনায় সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে দুই দেশই একমত।
পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সম্ভবত অনেক বছর ধরে চলমান অবস্থার চেয়ে এখন কিছুটা ভালো। গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খানের বিদায় নিঃসন্দেহে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতিতে সাহায্য করেছে। ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি নিয়মিত ট্রাম্প এবং বাইডেন প্রশাসনের প্রকাশ্য সমালোচনা করতেন। এটি দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়তা করেনি।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূগোল বিবেচনায় আফগানিস্তান সব সময়ই পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে থাকবে। কিন্তু ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে বাইডেন প্রশাসন ক্রমবর্ধমানভাবে আফগানিস্তানের খোঁজখবর রাখতে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে।
ঐতিহাসিক এবং ভূরাজনৈতিক কারণে তালেবানের প্রতি ইসলামাবাদ এবং ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। তবু তারা এ বিষয়ে একমত হবে, যতক্ষণ তালেবান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবে, ততক্ষণ তাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা স্থাপন করা প্রশ্নের বাইরে থেকে যাবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ক্লাউডি রাকিসিটস অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন অবৈতনিক সহযোগী অধ্যাপক এবং ব্রাসেলসভিত্তিক সেন্টার ফর সিকিউরিটি, ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজির একজন ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো