আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০ একটি বিশেষ আইন, যার মাধ্যমে সরকার আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচারপ্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থীকে আদালতে দায়েরকৃত, দায়ের যোগ্য ও বিচারাধীন মামলায় আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান, সালিসি সেবা প্রদান ও আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে আইনজীবীর সম্মানী প্রদান করে আসছে। সরকার এই আইনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ওই সংস্থার অধীন প্রতিটি জেলায় একটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন করেছে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান এবং এটির পরিচালনা ও প্রশাসন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি জাতীয় পরিচালনা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত। একইভাবে জেলা পর্যায়ে জেলা ও দায়রা জজের সভাপতিত্বে একটি জেলা কমিটির ওপর জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পিত। জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে সহযোগিতা করার জন্য উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি আছে, যা আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০-এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কাজ করে যাচ্ছে।
সরকার আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০-এর ৭ ধারার ক্ষমতাবলে জাতীয় আইনগত সহায়তা নীতিমালা ২০১৪ প্রণয়ন করেছে এবং সেখানে আইনগত সহায়তাপ্রাপ্তির যোগ্যতা, তথা কারা কারা আইনগত সহায়তা পাবেন, সে মর্মে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। উল্লেখ্য, এই নীতিমালা অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তি, তাঁর আর্থিক সামর্থ্য যা-ই হোক না কেন, জেলা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে আইনগত তথ্যসেবা গ্রহণ, আইনগত পরামর্শ গ্রহণ কিংবা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। এ ছাড়া সরকার ওই আইনের ২৪ ধারার ক্ষমতাবলে আইনগত সহায়তা প্রদান প্রবিধানমালা ২০১৫-সহ ওই আইনের ২২ক ও ১২ক ধারার উদ্দেশ্যসহ অন্যান্য উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কয়েকটি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করেছে। সরকার ২০১৭ সালে দেওয়ানি কার্যবিধির ৮৯এ ধারা সংশোধনপূর্বক জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে দেওয়ানি বিচারাধীন মামলা মধ্যস্থতার জন্য প্রেরণের বিধান করেছে।
উপরিউক্ত শক্ত আইনি কাঠামোর ওপর জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা এবং প্রতিটি জেলায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিস সরকারি আইনগত সহায়তাসেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা জাতীয় পর্যায়ে অতিপরিচিত, কল্যাণমুখী ও জনপ্রিয় সংস্থায় পরিণত হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে ন্যাশনাল লিগ্যাল এইড হেল্প ডেস্ক, হটলাইন স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রচার, প্রচারণার মাধ্যমে জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা সার্বক্ষণিক সুবিধাভোগী জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত আছে এবং তাদের আইনগত সহায়তা পাওয়ার অধিকারকে বেগবান করছে। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে অধিকার সচেতন মানুষ তাঁদের আইনগত সহায়তাপ্রাপ্তির অধিকার সম্পর্কে দ্রুত সচেতন হচ্ছেন এবং প্রতিনিয়ত জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে সেবা গ্রহণের জন্য আসছেন। ফলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসগুলো জেলা পর্যায়ে আইনি সহায়তা, আইনি পরামর্শ এবং সালিসি সেবা প্রদান কেন্দ্র হিসেবে দ্রুত পরিচিতি লাভ করছে।
আদালতকে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে বিচারক এবং বিচারপ্রার্থীর মধ্যে লালসালুর দূরত্ব ঘোচাতে হবে। জনগণের কল্যাণে প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আদালত অঙ্গনে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন এবং তার কর্মপ্রয়াস আদালতকে একটি জনমুখী ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অভিনব সরকারি প্রয়াস। এই প্রয়াসকে বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচারণার মাধ্যমে এর সুফল সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে এবং সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি আইনি সেবা পৌঁছে দিতে হবে।
জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা হওয়ায় সুবিধাভোগী জনগণ আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁদের আইনগত সমস্যাগুলো তাঁর কাছে তুলে ধরেন। জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা তাঁর বিচারিক ও প্রশাসনিক জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁদের প্রয়োজন অনুসারে আইনি পরামর্শ, আইনগত সহায়তা বা সালিসি সেবা প্রদান করেন। এতে বিচার বিভাগের সঙ্গে বিচারপ্রার্থী জনগণের প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সংবেদনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে মানুষ বিচার বিভাগের ওপর আরও আস্থাশীল ও নির্ভরশীল হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হলো সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী, মানুষকে ন্যায়বিচার প্রদান করা। সম্ভাব্য কম সময়ে এবং কম খরচে বিচারিক সেবা প্রদান করা। বিচারপ্রার্থী জনগণ ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে বঞ্চনার গ্লানি নিয়ে আদালত চত্বরে তাঁর দাবি নিয়ে আসেন। এই দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, মুহুরি, আদালতের কর্মচারী, পুলিশ, বিচারকসহ আরও অনেক পেশার লোকজনের কাছে তাঁকে ঘুরতে হয়। সবার সম্মিলিত কর্মে বিচারিক সেবার যে রূপ দাঁড়ায়, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থী মানুষের কাছে ভালো ঠেকে না। বিচার অঙ্গনে সাধারণ মানুষের অনেক হয়রানি এবং খরচা হওয়ার কথা শোনা যায়। এমন একটি অবস্থায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় আইনি সেবা প্রদানের সরকারি ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিস প্রতিটি জেলায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা আদালতগুলোর একটি নতুন জানালা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই জানালার মাধ্যমে আদালত ও বিচারকের সঙ্গে অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থীসহ সর্বসাধারণের একটি যোগসূত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আদালত ও বিচারকেরা সহানুভূতি ও সমানুভূতির মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীকে বিচারিক সেবা প্রদানে প্রয়াসী হচ্ছেন। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে আদালতের সঙ্গে বিচারপ্রার্থীর যে সেতুবন্ধ রচিত হচ্ছে, তাতে আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ও নির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে আমি মনে করি।
আমি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সিলেট জেলার লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মোট ৯৭৬ বিচারপ্রার্থীকে মামলা করার জন্য আইনগত সহায়তা প্রদান করেছি, ২৬০ জনকে আইনগত পরামর্শ প্রদান করেছি এবং ৭৪টি মধ্যস্থতার মধ্য থেকে সালিস বৈঠকের মাধ্যমে ৪৭টি নিষ্পত্তি করেছি ও ২২৪ জনকে সালিসি সেবা প্রদান করেছি। আমার জেলা লিগ্যাল এই কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বুঝতে পেরেছি যে মানুষ রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে তাঁদের অভাব-অভিযোগ ও সমস্যা সমাধানের প্রত্যাশা করেন। তাঁরা চান, সরকারি কর্মচারীরা মনযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শুনুন এবং তাঁদের সহজভাবে সমাধানের পথ বাতলে দিন। নির্বাহী বা বিচারিক আমলাতান্ত্রিকতা তাঁরা পছন্দ করেন না, তাঁদের প্রত্যাশা রাষ্ট্র, সরকার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের প্রতি মানবিক আচরণ করুক। জনগণের এই পালস বা অনুভূতি বুঝতে না পারলে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান জনবান্ধব বলে বিবেচিত হবে না।
আদালতকে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে তাই বিচারক এবং বিচারপ্রার্থীর মধ্যে লালসালুর দূরত্ব ঘোচাতে হবে। জনগণের কল্যাণে প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আদালত অঙ্গনে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন এবং তার কর্মপ্রয়াস আদালতকে একটি জনমুখী ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অভিনব সরকারি প্রয়াস। এই প্রয়াসকে বাস্তবায়ন করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচারণার মাধ্যমে এর সুফল সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে এবং সাধারণ মানুষের কাছে সরকারি আইনি সেবা পৌঁছে দিতে হবে।
এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর ২৮ এপ্রিল সারা দেশে জাতীয় লিগ্যাল এইড দিবস পালন করা হয়ে থাকে। জাতীয় লিগ্যাল এইড দিবসে জাতীয় ও জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কার্যক্রম সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। সরকারি ও বেসরকারি অংশীজন ও সুবিধাভোগীদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে এই দিবস পালনের মাধ্যমে সরকারের এই কল্যাণমূলক সেবা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা হয়ে থাকে এবং এ সম্পর্কে সর্বসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। দেশের ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তথাপি এ বিষয়ে আরও জনসচেতনতা বৃদ্ধির আবশ্যকতা আছে বলে আমি মনে করি। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসকে ন্যায়বিচারের বাতিঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে একটি আইনি পরামর্শ ও সালিশ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য বিচারকদের ও লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের জনবল, কর্মদক্ষতা ও তহবিল বৃদ্ধিতে সরকারকে আরও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিতে হবে।
ফাইরুজ তাসনীম জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা, সিলেট