অন্যের কথা শোনার সদিচ্ছা ও চর্চা কেন প্রয়োজন

লন্ডনে একটা বাসায় ঘরোয়া অনুষ্ঠান চলছিল। অতিথির সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। আয়োজক নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। প্রায় দুই যুগ আগে তাঁর স্ত্রী ইভা কলোরনির মারা গিয়েছেন। তাঁর স্মরণে বার্ষিক বক্তৃতা চলছিল। প্রফেসর সেন অনুষ্ঠানের মধ্যে ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকের কাছে যাচ্ছেন। কথা বলছেন। কথা বলছেন বলাটা ভুল হবে। মূলত তিনি শুনছিলেন। আমার পালা এল। আমার প্রতি তাঁর মনোযোগ নিরবচ্ছিন্ন। মনে হলো ওই ঘরে আর কোনো লোক নেই আমি ছাড়া। আমার কাজের কথা শুনলেন। যাদবপুরের কথা শুনলেন। তখনই বলেছিলেন, আত্মজীবনী লিখতে শুরু করেছেন। যাঁর কথা শোনার জন্য সারা বিশ্বের বিজ্ঞজনেরা বছরের পর বছর অপেক্ষা করেন, তিনি কিনা মন দিয়ে অন্যের কথা শুনছেন।

অমর্ত্য সেনের বলার বিষয়ের নিশ্চয়ই কোনো অভাব নেই। গণিত, দর্শন বা অর্থনীতি, সব বিষয়েই তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য।

লর্ড মেঘনাদ দেশাই অমর্ত্য সেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সাবেক সহকর্মী। নামকরা ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ। তাঁকেও দেখলাম সবার কথা মন দিয়ে শুনছেন।

আরও পড়ুন

ইম্পিরিয়াল কলেজে আমাদের রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বড় কর্তা ছিলেন প্রফেসর রিচার্ড ওয়াইজ। তিনি নিউরোলজিস্ট। বিশ্বজুড়ে তাঁর খ্যাতি। তাঁর ল্যাবের গবেষণা বরাদ্দ ছিল বছরে শত কোটি টাকারও বেশি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি রিচার্ড প্রতিটি প্রজেক্টের খুঁটিনাটি খুঁটিয়ে শুনতেন। যখন কোনো সিদ্ধান্তের দরকার হতো, নিজের মতামত জানানোর আগে প্রশ্নকর্তার কাছে তাঁর মতামত জানতে চাইতেন।

অনেকবার দেখেছি, সদ্য কাজে যোগ দেওয়া গবেষকদের কথাও তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, আমাদের জীবনের অর্ধেক বা তারও বেশি সময় ব্যয় হয় অন্যের কথা শুনতে, না হলে শোনাতে।

কথোপকথন সার্থক আলাপে পরিণত হয়, যখন কিনা একে অন্যের কথা মন দিয়ে শোনে। আলাপেই তৈরি হয় সম্পর্ক। অনেক সময় আলাপের অভাবেই আড্ডা শেষ। আলাপেই তৈরি হয় যুগান্তকারী সব ধারণার।

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ক্রিক কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন। তখন সেখানে ঘুরতে এসেছিলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন। বয়সে ক্রিক থেকে ১২ বছরের ছোট ওয়াটসন। কিন্তু প্রথম কথোপকথনেই তাঁরা বুঝেছিলেন বিজ্ঞান নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলাপ করতে পারবেন। পরে দুজনেই নোবেল পান ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের জন্য।

ল্যারি পেইজ আর সেরগেই ব্রিন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে প্রথম দিনেই আলাপটা জমে গিয়েছিল দুজনের। একে অন্যের সঙ্গে দ্বিমত ছিল অনেক বিষয়ে। দুজনেই দুজনের কথা শুনলেন। মন দিয়ে। আস্তে আস্তে দৃঢ় হতে থাকে তাঁদের বন্ধুত্ব। তাঁদের যৌথ ভাবনা থেকে জন্ম হয় গুগলের। তাঁরা যদি একে অন্যের কথা মন দিয়ে না শুনতেন, দ্বিমতের জন্য আলাপ যদি আর না বাড়ত প্রথম দেখার পরে, আমরা হয়তো গুগলকেই পেতাম না।

আরও পড়ুন
একদম নীরবতা ভালো নয়। গং রিসার্চ ল্যাব নামে এক বেসরকারি সংস্থার গবেষণামতে, যেকোনো আলাপচারিতায় আপনি যদি ৬০ শতাংশ সময়ে মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা নেন, তাহলে আপনার সম্পর্কে আলোচনার অন্য প্রান্তের মানুষটি ভালো ধারণা পোষণ করবেন। বাকি ৪০ শতাংশ সময়ে আপনার আলোচনায় অংশ নিতে হবে, অর্থাৎ বলতে হবে।

অন্যের কথা মন দিয়ে শোনার প্রবণতা আমাদের কমে আসছে। ঘরে-বাইরে-কাজে, সব জায়গাতেই। কথা শোনা আর মন দিয়ে কথা শোনা বা অনুধাবন করা, মনে রাখা এক নয়। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, কোনো কিছু শোনার আট ঘণ্টা পরে অনেকেই অর্ধেকের বেশি ভুলে যান। ভুলে যাওয়ার এই প্রবণতা এখন আরও বেড়েছে বলেই ধারণা করা হয়।

অন্যের কথা শোনার জন্য সদিচ্ছা ও চর্চার প্রয়োজন। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া বলতে পারেন। সফল হওয়ার জন্য, অন্যের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরির জন্য মন দিয়ে কথা শুনতে শেখাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি শর্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা অনেকেই এটি জানি না। অনেকের ধারণা, বুদ্ধিমান লোকেরা আলাপে কথা বলার চেয়ে অন্যের কথা শুনতে বেশি আগ্রহী থাকেন। কিন্তু বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অন্যের কথা শোনার প্রবণতার সম্পর্কটি বিজ্ঞানে প্রমাণিত নয়। অন্যকে বলতে দেওয়া, অন্যের কথা শোনা মোটেও সহজ নয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যেকোনো আলাপে নিজের সম্পর্কে বলতে আমরা খুবই উৎসাহী বোধ করি। দারুণ এক সুখানুভূতি তৈরি হয়। সুখানুভূতি তৈরি হলে মস্তিষ্ক সেই কাজ বারবার করতে উৎসাহিত করে।

তবে আরও কারণ আছে। গড়পড়তার একজন মানুষ প্রতি মিনিটে ১২৫টির মতো শব্দ বলে থাকেন। মানবমস্তিষ্ক অত্যন্ত শক্তিশালী এক প্রসেসর, যে কিনা মিনিটে ১২৫ থেকে অনেক বেশি শব্দ প্রসেস করে, মর্মার্থ বের করতে সক্ষম। অর্থাৎ এক মিনিটে আপনার বলা শব্দগুলো আমার মস্তিষ্ক প্রসেস করার পরও মস্তিষ্কে অব্যবহৃত ক্ষমতা থেকে যায়। আর সমস্যাটা এখানেই। অব্যবহৃত ক্ষমতা তখন ব্যয় হয় অন্য কোনো অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভাবতে। আর তখনই আপনি বিষয়ের প্রতি অমনোযোগী হয়ে ওঠেন।

ধীরে ধীরে চর্চার মাধ্যমে মস্তিষ্কের এই প্রবণতা পরিবর্তন করা সম্ভব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্যের কথা শোনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় বা কাজের জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এত দিনে গুরুত্বের সঙ্গে দেওয়া হয়নি। এই প্রবণতার পরিবর্তন হচ্ছে। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ বিষয়। কোম্পানির বড় কর্তারাই কর্মীদের বক্তব্য শুনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কর্মীদের বলতে উৎসাহিত করছেন। শুনছেন গ্রাহকদের কথাও। যেমন ধরুন, রেস্তোরাঁ চেইন পিৎজা হাটের সিইও ইয়েনস হফমা নিয়মিত পালা করে ব্যস্ত রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে কর্মীদের কথা শোনেন। শোনেন গ্রাহকদের ভালো আর মন্দ লাগার কথা। মাইক্রোসফটের সিইওর দায়িত্ব নিয়েই সত্য নাদেলা মিটিং নিয়ে নতুন নির্দেশনা দেন। বলতে হবে কম। শুনতে হবে বেশি। বিশেষ করে বড় কর্তাদের।

গুগলের সিইও সুন্দর পিচাইও বলার থেকে শুনতে বেশি পছন্দ করেন। অধিকাংশ মিটিংয়ে তিনি সবার কথা শেষ হলে তবেই মুখ খোলেন। যেকোনো কথোপকথনকে আকর্ষণীয় করতে বেশ কিছু কার্যকর পদ্ধতির উল্লেখ করা হয়েছে সাম্প্রতিক বিভিন্ন নিবন্ধ ও বইয়ে। যেকোনো আলাপচারিতায় নীরবতার একটা ভূমিকা আছে।
নীরবতার মাধ্যমেই আলোচনা দীর্ঘ হয়। কোনো আলাপে একজন চুপ হয়ে গেলে আমরা ভাবি তাঁর কথা শেষ। তখনই আমরা বলতে শুরু করি। এতে অন্যের চিন্তায় বিঘ্ন ঘটে। সার্থক আলোচনা অনেকটাই টেবিল টেনিসের মতো।

এখানে দুপক্ষেরই অংশগ্রহণ প্রয়োজন। একদম নীরবতা ভালো নয়। গং রিসার্চ ল্যাব নামে এক বেসরকারি সংস্থার গবেষণামতে, যেকোনো আলাপচারিতায় আপনি যদি ৬০ শতাংশ সময়ে মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা নেন, তাহলে আপনার সম্পর্কে আলোচনার অন্য প্রান্তের মানুষটি ভালো ধারণা পোষণ করবেন। বাকি ৪০ শতাংশ সময়ে আপনার আলোচনায় অংশ নিতে হবে, অর্থাৎ বলতে হবে। ভালো শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা আজ থেকে থেকেই শুরু হোক তাহলে।

  • ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
    [email protected]