সুদানের রাজধানী খার্তুমে গত শনিবার থেকে যে লড়াই শুরু হয়েছে, সেটি দেশটির ৭০ লাখ মানুষকে নানামুখী সংঘাতপূর্ণ বাস্তবতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। জনাকীর্ণ নগরগুলো এখন মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। বিশেষ করে ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা একেবারে স্থবির হয়ে পড়ার অবস্থায় চলে গেছে; পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং বাইরে থেকে খাদ্যপণ্য শহরে ঢোকা উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে পড়ছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের ক্ষমতাকালের শেষ কয়েক বছরে সুদানে যে বিভক্তি বাড়ছিল, ২০১৯ সালে তাঁর পতনের পর তা অধিকতর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছে। আজকের এই অবস্থা সেই বিশৃঙ্খলারই পরিণতি।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সুদান কয়েক দফা বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণে সেখানে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং আদিবাসী ও উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিবাদ বেড়েছে। সম্পদের দখল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা–মারামারি সামরিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে এবং সেটি পুরোনো গোষ্ঠী দ্বন্দ্বকে চাগিয়ে তুলেছে।
ইতিমধ্যেই খার্তুমের মিত্রবাহিনী হিসেবে কাজ করা মিলিশিয়ারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের সামরিক ব্যবস্থার এই অসংগতি দেশটিতে তথাকথিত র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামের একটি ভয়ংকর দানবের জন্ম দিয়েছে। আরএসএফ নামের এই আধা সামরিক বাহিনী এখন গদি দখলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে।
মোহাম্মাদ হামদান ‘হেমেদতি’ দাগালোর নেতৃত্বাধীন আরএসএফ-সম্পর্কে জানতে আমাদের ২০০৩ সালের আগে যেতে হবে। ওই সময়টাতে সুদানের দারফুর এলাকায় বিদ্রোহ দমন করার জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আল বশিরের সরকার যতগুলো সশস্ত্র উপজাতি গোষ্ঠীকে মাঠে নামিয়েছিল, তার একটার নেতৃত্বে ছিলেন মুসা হিলাল নামের এক যুদ্ধবাজ নেতা। মুসা হিলাল দারফুরে তাঁর গ্রুপের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন মোহাম্মাদ হামদান ‘হেমেদতি’ দাগালোকে।
অল্প সময়ের মধ্যেই হেমেদতি নির্দয় ও নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠেন এবং তাঁরই নিয়োগদাতা হিলালের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়েন। ২০১৩ সালে হিলাল বশির সরকারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার পর প্রেসিডেন্ট বশির একটি ডিক্রি জারি করে সব কটি সরকারপন্থী মিলিশিয়া গ্রুপকে এক করে আরএসএফ গঠন করেন এবং তার প্রধান হিসেবে হেমেদতিকে নিয়োগ দেন।
কয়েক মাস ধরে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা আরএসএফের আগ্রাসী আচরণে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তাঁরা সেটি তাদের বিদেশি মিত্রদের জানিয়েও রেখেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তঁাদের সেই উদ্বেগ মোটেও অমূলক ছিল না। ভেবে অবাক হতে হয়, যে মিলিশিয়া বাহিনীর জন্ম হয়েছে একটি যুদ্ধবাজ পরিবারের মধ্য থেকে এবং যারা আইন আদালতের কোনো তোয়াক্কাই করে না, তাদের গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের অন্তর্বর্তী পর্ষদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
২০১৫ সালে সুদানের সবচেয়ে বড় বাহিনী হিসেবে আরএসএফ সৌদি আরবের হয়ে ইয়েমেনে যুদ্ধ করতে যায়। ওই যুদ্ধে আরএসএফ ও সৌদির মধ্যে যে কর্মকর্তা মধ্যস্থতা করছিলেন, তিনিই হলেন আজকের সুদানি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল বুরহান। তিনি এর আগে দারফুরে দীর্ঘ সময় হেমেদতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। হেমেদতি এবং বুরহান দুজনেই সৌদি এবং আমিরাতের নেতাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং ইয়েমেনে লড়াইরত নিজের মিলিশিয়া বাহিনীর কারণে হেমেদতির ভাগ্য খুলে যায়।
২০১৭ সালে সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক উপাদান হিসেবে আরএসএফকে স্বীকৃতি দিয়ে সুদানে একটি আইন পাস করা হয়। সে আইনে বলা হয়, আরএসএফ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত একটি বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। বাহিনীটি সরাসরি প্রেসিডেন্টের আদেশাধীন থাকবে। এর কিছুদিন পরই সেনাবাহিনীর কাছে দুর্নীতি ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট বশির অবিশ্বস্ত হয়ে ওঠায় তিনি খার্তুমে আরএসএফকে একটি সেনাঘাঁটি গড়তে অনুমতি দেন। ওই সময় থেকে হেমেদতি আরও ক্ষমতা ও সম্পদ কুক্ষিগত করতে থাকেন এবং অচিরেই সুদানের সবচেয়ে ধনী লোক হয়ে দাঁড়ান।
একটি কুখ্যাত মিলিশিয়া বাহিনীকে ক্ষমতার উচ্চস্তরে অন্তর্ভুক্ত করা রাষ্ট্রের অখণ্ডতার সঙ্গে আপস করার শামিল। এটি দেশটির অস্থিতিশীলতার গতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। পরিণামে অরাষ্ট্রীয় সামরিক শক্তি তাদের আধিপত্যকে মজবুত করেছে এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকেই শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করে বসেছে।
প্রেসিডেন্ট বশিরের পতন সংকট কাটানোর বদলে তাকে আরও ঘনীভূত করেছে। বশিরের পতনের পর ২০১৯ সালে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সার্বভৌম পর্ষদ শাসনক্ষমতা নেয়। হেমেদতিকে এই পর্ষদের উপপ্রধান অর্থাৎ কার্যত ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। এটি হেমেদতির উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
হেমেদতি আরএসএফকে সেনাবাহিনীর সমান্তরাল বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। তিনি খার্তুম ও ১৭টি প্রদেশে শিবির গড়ে সেখানে প্রায় এক লাখ সেনার অবস্থান ঘটান। তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল মেরোই বিমানবন্দর দখল করে সেখানে বিমানঘাঁটি গড়া।
কয়েক বছর ধরে হেমেদতি সেনাবাহিনীর আদলে অস্ত্রাগার গড়ে চলেছেন। তাঁর অধীন পাইলটদের বিদেশে গিয়ে জঙ্গি বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি তাঁর বাহিনীতে ফাইটার জেট যুক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর একটা এয়ারফিল্ড দরকার ছিল। তাঁর সর্বশেষ লক্ষ্য ছিল সুদানের সশস্ত্র বাহিনী করায়ত্ত করা।
কয়েক মাস ধরে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা আরএসএফের আগ্রাসী আচরণে উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তাঁরা সেটি তাদের বিদেশি মিত্রদের জানিয়েও রেখেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তঁাদের সেই উদ্বেগ মোটেও অমূলক ছিল না। ভেবে অবাক হতে হয়, যে মিলিশিয়া বাহিনীর জন্ম হয়েছে একটি যুদ্ধবাজ পরিবারের মধ্য থেকে এবং যারা আইন আদালতের কোনো তোয়াক্কাই করে না, তাদের গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের অন্তর্বর্তী পর্ষদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
এটি না করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় যদি একটি বেসামরিক পর্ষদ গঠন করে তার অধীনে সেনাবাহিনী ও আরএসএফকে একীভূত করে রাখা হতো, তাহলে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ সুদানের পক্ষে অনেক সহজ হতো। অন্তত আজকের এই সংকটে দেশটিকে পড়তে হতো না।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আব্দেলওয়াহাব এল-আফেন্দি দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক