বিশ্বব্যাংকের গবেষণা এবং সংশ্লিষ্ট অনেক জরিপের তথ্যমতে, বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রবাসী রেমিট্যান্সের আকার ৪০ থেকে ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নিজেই বলেছিলেন, এই সম্ভাব্য রেমিট্যান্সের শুধু ৫১ শতাংশ অফিশিয়াল বা বৈধ চ্যানেলে আসে। বাকিটা বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রায় নিষ্পন্ন হয় মূলত নগদ টাকায়, যাকে সুপরিচিতভাবে বলা হয় হুন্ডি।
এ ক্ষেত্রে মূল অভিযোগ হলো, হুন্ডির বৈদেশিক মুদ্রা কখনো দেশে আসে না, চলে যায় বিদেশে আর ব্যবহৃত হয় আন্ডার-ইনভয়েসিং বা মানি লন্ডারিংয়ে।
গেল তিন বছরে প্রতিবছর গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২২ থেকে ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু কোভিডকালেই আমরা সম্ভবত হুন্ডি চ্যানেল বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স দেখেছি, ২৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। গেল দুই বছর বিনিময় হার নিয়ে নানা কসরত বা চাপাচাপি প্রবাসীদের অনেকটা হুন্ডিনির্ভর করে ফেলে।
প্রাথমিক পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা ছিল একই মালিকানাধীন অনেক এক্সচেঞ্জ হাউসেরও। তাদের বৃহত্তর মালিকানায় অনেক ব্যাংক থাকায় তারা প্রবাসীদের আগাম ঋণ দিতে, এমনকি ঘরে ঘরে গিয়ে বিদেশি মুদ্রার বিপরীতে বেশি টাকাও পৌঁছে দেয়। সেই সঙ্গে অন্য কিছু এক্সচেঞ্জ হাউসও হাত মেলায়।
বিগত সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্রীয়ভাবে সহজে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানি ও বিদেশি দায় মেটানোর সুবিধায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ধরে রাখে। এতে অফিশিয়াল ও হুন্ডি চ্যানেলের দামে বিরাট ব্যবধান দেখা দেয়। অফিশিয়াল চ্যানেলে ডলার আসা অনেক কমে যায়। ইতিমধ্যে ক্রলিং পেগ বা অন্যান্য কারণে টাকার বিপরীতে ডলারের দামকে বাড়তে দেওয়া হলে অফিশিয়াল চ্যানেলে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায় এবং অফিশিয়াল ও হুন্ডির দামে পার্থক্য অনেক কমে আসে।
তবে গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং এতদসংক্রান্ত জটিলতায় রেমিট্যান্স আবার কমে আসে, এমনকি কোথাও কোথাও রেমিট্যান্স না পাঠানোর দাবিও ওঠে। জীবিকার দায়ে প্রবাসে যাওয়া বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী ব্যক্তিদের জন্য এটা যদিও সম্ভব নয়, তবুও প্রচুর হুন্ডি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সমস্যার সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের সোনা কেনার হিড়িক। তাঁরা যদি বিদেশি মুদ্রায় রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে সোনার বার কিনে নিয়ে আসেন, শোনা যাচ্ছে তাতে যেমন তাঁরা একটু বেশি টাকা পান, সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে আসা-যাওয়ার টিকিট এমনকি এয়ারপোর্ট থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার টাকাও উঠে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান অর্থবছরের জুলাই মাসের ধারায় রেমিট্যান্স কমতে থাকলে ব্যাংকে আমদানি দায় নিষ্পত্তি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে রপ্তানি, বিদেশি সাহায্য এবং বিনিয়োগ কমে গেলে আর মুদ্রা পাচার ঠেকানো না গেলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে সন্দেহ নেই।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইদানীং দেশে প্রবাসী আয় আসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। সদ্য বিদায়ী জুলাই মাসে যে আয় এসেছে, তা গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই মাসে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবাসী আয়–সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সরকারি ও সাধারণ ছুটি মিলিয়ে গত ১৯ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল। এ ছাড়া টানা ৫ দিন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও ১০ দিন মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। এ কারণে দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈদেশিক লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
জানা যায়, গত মাসের প্রথম ৩ সপ্তাহে গড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। এর মধ্যে ১ থেকে ২০ জুলাই এসেছে ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। আর ২১ থেকে ৩১ জুলাই এসেছে ৪৭১ মিলিয়ন ডলার।
গত জুনে ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার আয় দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিরা। জুনে দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছিল, তা ছিল একক মাস হিসেবে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাইয়ে ২ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কেউ বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়ে থাকলে ব্যাংকগুলো তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিতরণ করতে বাধ্য। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশের প্রবাসী আয় প্রেরণকারী রেমিট্যান্স হাউসগুলো যদি এ আয় ধরে রাখে, তাহলে তা দেশে আসতে কিছুটা সময় লাগে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণত দুই থেকে তিন দিনের বেশি সময় লাগে না।
পত্রিকান্তরে জানতে পেরেছি, প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ১২ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে ডেকে প্রবাসী আয় বাড়াতে জোর দেওয়ার তাগিদ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো আগে প্রবাসী আয় সংগ্রহে প্রতি ডলারে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকা দিয়ে আসছিল। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার তাদের কিছুটা বাড়তি দাম দিয়ে হলেও বৈধ পথে আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ফলে প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম সম্প্রতি ১২০ টাকায় উঠেছে।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে ডলার-সংকট চলছে। এ সংকট কাটাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় তদারকিও কমিয়েছে। পাশাপাশি যেকোনো ধরনের অর্থ বৈধ পথে দেশে আনার ক্ষেত্রে যে নিয়মকানুন রয়েছে, তা শিথিল করেছে। গত কয়েক মাসে তাই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় দেশে আসার ক্ষেত্রে। জুলাই মাসে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে।
আগেই বলেছি, ২০২০ সালে কোভিডের সময়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে দেশে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়। তখন প্রতি মাসে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ গড়ে ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।
বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় আসার কারণে একপর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে যায়। দেখা দেয় ডলার-সংকট। সেই সঙ্গে জোর করে ডলারের দাম ধরে রাখায় হুন্ডির ব্যাপকতায় দেখা দেয় তারল্যসংকট। ইতিমধ্যে দাম বাড়লেও সংকট এখনো কাটেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান অর্থবছরের জুলাই মাসের ধারায় রেমিট্যান্স কমতে থাকলে ব্যাংকে আমদানি দায় নিষ্পত্তি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে রপ্তানি, বিদেশি সাহায্য এবং বিনিয়োগ কমে গেলে আর মুদ্রা পাচার ঠেকানো না গেলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে সন্দেহ নেই।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক।