১২ আগস্ট তারিখের প্রথম আলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-সম্পর্কিত আমাদের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১১ সালের ১০ মে তারিখে প্রদত্ত (৪-৩) বিভক্ত সংক্ষিপ্ত আদেশ সম্পর্কে কলামিস্ট সোহরাব হাসান লিখেছেন, ‘আদালত সংক্ষিপ্ত আদেশে বলেছিলেন, সংসদ চাইলে দুটি নির্বাচন এ ব্যবস্থায় (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে) হতে পারে।’ একই তারিখের যুগান্তর পত্রিকায় ড. এম এ এস মোল্লা একই দাবি করেন, ‘সংসদ চাইলে আরও দু টার্ম এরূপ সরকারের অধীনে হতে পারে বলে সংক্ষিপ্ত রায়’ দেন আপিল বিভাগ।
সংক্ষিপ্ত আদেশটি প্রদানের অব্যবহিত পরে সরকারের পক্ষ থেকেও একই দাবি করা হয়। বলা হয়, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি...আদালত বাতিল করেছেন। আদালতের রায়কে অস্বীকার করা কখনো সম্ভব নয়। আইনের শাসন মানলে আদালতের রায় মেনে চলতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে বলা হয়েছে, সংসদ মনে করলে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আসতে পারে। তবে বিচার বিভাগকে জড়িত করা যাবে না।’ (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১১)।
সরকারের এমন দাবির ভিত্তিতে আদালতের আদেশ পালন করতেই, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাদ দিয়ে নবম জাতীয় সংসদ ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে। প্রসঙ্গত, প্রায় ১৬ মাস পর ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২ প্রকাশিত আপিল বিভাগের বিস্তারিত রায় এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, ১০ মে ২০১১ তারিখের সংক্ষিপ্ত আদেশের ভিত্তিতেই, বিস্তারিত রায়ের জন্য অপেক্ষা না করেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করা হয়।
সরকারের এই অবস্থানের বিপরীতে ব্যারিস্টার আদিবা খান ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ অব ল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দাবি করেন, ‘বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ এবং ভোটারদের বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সংসদে তার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী দুই জাতীয় নির্বাচনের সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকার আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছে।’ গবেষক রিদওয়ানুল হকও এক আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে পঞ্চদশ সংশোধনীকে ‘অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধনী’ বলে আখ্যায়িত করেন।
এটি সুস্পষ্ট যে প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত আদেশটি নিয়ে সরকার–বিশিষ্টজন ও গবেষকদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সরকার ও বিশিষ্টজনদের মতে, আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল-সম্পর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনী একতরফাভাবে পাস করা হয়। এর বিপরীতে, গবেষকদের মতে, আদালতের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
এ দুটি বিপরীতমুখী অবস্থানের কোনটি সঠিক? এই সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য সংক্ষিপ্ত আদেশটির দিকে নজর দেওয়া যাক। আপিল বিভাগের ২০১১ সালের ১০ মে প্রদত্ত আদেশে বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রসপেক্টেভলি (বা ভবিষ্যতের জন্য) বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো। যা সাধারণত আইনসিদ্ধ নয়, প্রয়োজন তাকে আইনসিদ্ধ করে, জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন—এ সকল সনাতন তত্ত্বের ভিত্তিতে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্বে উল্লেখিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে সংসদ ইচ্ছা করলে এরই মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে।’
সরকার ও গবেষকদের বিপরীতমুখী অবস্থানের পেছনে যুক্তি হলো যে সংসদের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়টি আদালতের পর্যবেক্ষণ, আদেশ নয়। এই মতামত যে সঠিক নয়, আমাদের দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের অভিমতের দিকে তাকালেই তা সুস্পষ্ট হয়।
উপরিউক্ত আদেশ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে আদালত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সংসদের সম্মতির শর্ত দেননি। বরং আদালত তার সংক্ষিপ্ত আদেশে ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা এবং জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সম্মতি দিয়েছেন। অর্থাৎ আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
সরকার ও গবেষকদের বিপরীতমুখী অবস্থানের পেছনে যুক্তি হলো যে সংসদের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের বিষয়টি আদালতের পর্যবেক্ষণ, আদেশ নয়। এই মতামত যে সঠিক নয়, আমাদের দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞদের অভিমতের দিকে তাকালেই তা সুস্পষ্ট হয়।
উদাহরণস্বরূপ, প্রয়াত এম জহিরের মতে, ‘আগামী দশম ও একাদশ নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। কিন্তু বিচারকদের না জড়ানোর জন্য সংসদ সংশোধনী আনতে পারবে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।’ (বাংলা নিউজ, ১০ মে ২০১১)। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন–এর (২ জুন ২০১১) এক প্রতিবেদনে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়: ‘আগামীতে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে—এটি আপিল বিভাগের আদেশ, পর্যবেক্ষণ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বেআইনি হলেও প্রয়োজন এটাকে আইনানুগ করেছে বলে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে...সরকার নিজেদের সুবিধার জন্য রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে পর্যবেক্ষণ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে...বলছেন আগের অংশ জাজমেন্ট পরের অংশ জাজমেন্ট নয়...কেন এটা বলছেন বোধগম্য নয়...অবশ্য পলিটিকস করতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। নিজে বিশ্বাস না করলেও অনেক সময় বলতে হয়।’
একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে সংবিধান-বিশেষজ্ঞ প্রয়াত মাহমুদুল ইসলামের তাঁর কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ গ্রন্থে বলেছেন, ‘একটি নিন্দিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে আগামী দুই সংসদ নির্বাচনের জন্য জিইয়ে রেখে আপিল বিভাগ বিচারিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আইনসভার সংবিধানপ্রদত্ত দায়িত্ব পালনের ওপর হস্তক্ষেপ করেছেন, যা সুপ্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক আইনশাস্ত্র, আইনের শাসন ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থী।’ এই বক্তব্যে তিনি ভবিষ্যতের জন্য বাতিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে পরবর্তী দুই নির্বাচনে ব্যবহারের আদালতের আদেশের সমালোচনা করেছেন।
এ ছাড়া সাবেক আইনমন্ত্রী প্রয়াত আবদুল মতিন খসরু সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির ২৪তম বৈঠকে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করেন যে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান হলো আদালতের আদেশ এবং বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে বাদ দেওয়া হলো পর্যবেক্ষণ। একই বৈঠকে কমিটির সদস্যসচিব এ কে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, পরবর্তী দুই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে জীবন্ত রাখা না হলে আদালত বিচারপতিদের বাদ দিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী সংশোধনের পর্যবেক্ষণ দিতেন না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘তাহলে তো আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে।’
উপরিউক্ত পর্যালোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করেই পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে, অর্থাৎ এটি হলো অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধন। এটি অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধনী হওয়ার আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর সুবাদে গণভোট অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক হলেও পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সময়ে তা করা হয়নি। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭খ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদ অসংশোধনযোগ্য করা হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে সংবিধান সংশোধন করা সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক অধিকার, যা খর্ব করা যায় না, অর্থাৎ এক সংসদ ভবিষ্যৎ সংসদের হাত-পা বেঁধে দিতে পারে না।
● বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)