যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটা লক্ষ্য হচ্ছে, চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। কেননা, চীন এখন অর্থনীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং এ কারণেই প্রধান শত্রুও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটা লক্ষ্য হলো, চীনে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে যাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো মুনাফা করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা।
চীন নীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ডিকাপলিং (পুরোপুরি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা) অবস্থান থেকে সরে এসে অপেক্ষাকৃত মৃদু ডিরিস্কিং (শুধু ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিচ্ছিন্নতা) নীতি নিয়েছে। চীনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি যে বিভক্ত, এটা তারই লক্ষণ।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে নির্ভরতা, তার ওপর ভিত্তি করে চীন বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতি হওয়ার দিকে এগিয়ে চলেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব কঠিন এক বাস্তবতা। একইভাবে কয়েক দশক ধরে চীনের যে চমকজাগানিয়া প্রবৃদ্ধি, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার, ডলার ও সুদহারের সঙ্গে দেশটির অর্থনীতি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীন আজ একই সঙ্গে বিশাল সুযোগ ও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা রাশিয়ার দিক থেকে সেটা কখনো আসেনি। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়া, জার্মানি, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার, ৩ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার, ১৪ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ও ২০ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ডানপন্থী অংশ ও তাদের মিলিটারি—ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স (অস্ত্র ব্যবসায়ী গোষ্ঠী) কী চাইছে, সেটা তাদের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো কীভাবে পররাষ্ট্রনীতিকে প্রকাশ করছে, তা থেকে বোঝা যায়। বিশেষ করে গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম চীনের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাব, তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন ও যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে নেওয়া নীতি—এসব প্রশ্নে চীনকে দায়ী করে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের নেতৃত্বে চীন ছাড়ার যে নীতি তাতে যোগ দিতে জি-৭-এর ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করে, তাহলে ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা—ব্রিকসের এ দেশগুলো চীনের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তার সুবিধাটা নিয়ে নেবে। সদস্যদেশগুলোর জিডিপি একসঙ্গে করলে ব্রিকস এখন বিশ্বে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। জি-৭-এর সঙ্গে ব্রিকসের ব্যবধানটা ক্রমেই বড় হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় ব্যবসায়ীরা মুনাফাকে গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সহাবস্থানের পক্ষে কথা বলে আসছেন। তাঁদের এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি থেকে অনেক ভিন্ন। এই দুই মেরুর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি দোদুল্যমান থাকছে। জেপি মরগ্যান চেজ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী জেমি ডিমোন ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জেনেট ইয়েলেন বেইজিং সফরে গিয়ে দুই দেশের যৌথ স্বার্থের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে ‘স্বৈরশাসক’ বলেছেন।
ইতিহাস ও শীতল যুদ্ধের ঐতিহ্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারকে নিন্দা করতে অভ্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তি সব সময় চীনের সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে শীতল যুদ্ধের যুক্তি ও স্লোগান ব্যবহার করতে উদ্গ্রীব থাকে। পুরোনো (তাইওয়ান ও হংকং) ও নতুন ইস্যু (উইঘুর) তাদের প্রচারণার হাতিয়ার।
শীতল যুদ্ধের অবসান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে গতি সঞ্চার করেছে, সেটা কখনোই থেমে যাওয়ার নয়।
‘কমিউনিস্ট’ চীন পুঁজিবাদের মুনাফা জোগাচ্ছে
তুলনামূলক কম মজুরি ও দ্রুত বর্ধনশীল বাজারকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদী বিশ্ব (পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও জাপান) বিনিয়োগ করার মাধ্যমে চীন থেকে মুনাফা করছে। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চীনের উৎপাদিত পণ্য ও কাঁচামাল বিশ্বের বাজার সয়লাব করে দিচ্ছে।
চীন বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। চীন থেকে বিশ্বে যে রপ্তানি হয়, তার বেশির ভাগ লেনদেন হয় মার্কিন ডলারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ডলারের প্রবাহ আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশাল বাজেটঘাটতি, সেটা মেটাতে গিয়ে তারা চীনের সেই ডলারের বড় একটা অংশ ধার নিচ্ছে। জাপানের সঙ্গে যৌথভাবে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা দেশ।
চীন প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে যুক্তরাষ্ট্রে যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে আসছে, তার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদহার কমিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে তা সহায়তা করে চলেছে এবং একই সঙ্গে কয়েকটি অর্থনৈতিক সংকট থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পেরেছে।
চীন যে তুলনামূলক কম দামে পণ্য রপ্তানি করে, তা দেশটির কম মজুরির কারণে সম্ভব হয়। কম মূল্যে পণ্য রপ্তানির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। কম মূল্যের পণ্য নিয়োগদাতা শ্রেণির ওপর উচ্চ মজুরির চাপ কমায়। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিপতিদের মুনাফা করতে সহায়তা করছে চীন।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সংযোগ আমেরিকান পুঁজিবাদের বিকাশ ও সফলতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এই সংযোগ কাটা পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তা বিরাট প্রতিকূলতা নিয়ে আসবে।
এ ছাড়া চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার অনেক প্রস্তাবই অকার্যকর ও বাজে কল্পনাপ্রসূত। ওয়াশিংটন যদি তাদের বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে আনতে বাধ্য করে, তাহলে তারা এশিয়ার যেসব দেশ নিম্ন মজুরি দেয়, সেখানে তাদের ব্যবসা নিয়ে যাবে। তারা তাদের ব্যবসা কখনোই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনবে না।
কেননা, সেখানে কর্মীদের উচ্চ মজুরি দিতে হবে এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচও সেখানে অনেক বেশি। ব্যবসার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সেটা মোটেই অনুকূল হবে না।
আর চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশে যাবে, সেসব দেশের কাঁচামালের প্রধান উৎস চীন। সংক্ষেপে তাই বলা যায়, চীন থেকে আমেরিকান পুঁজিপতিদের জোর করে চলে আসতে বাধ্য করা হলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ সামান্যই। চীনের ক্ষতিও সামান্য।
যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোচিপের জন্য চীনের বাজারে বন্ধ করার প্রস্তাবটি বাজে কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। চীনের বিকাশমান বাজারে প্রবেশ করতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। কেননা, চীনে মাইক্রোচিপের যে বাজার, তার ধারেকাছেও অন্য কেউ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের জন্য চীনের বিনিয়োগ দরকার এবং চীনের বাজারে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবেশ দরকার। চীনের ক্রমবিকশিত বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যাংকের আসা প্রয়োজন না হলে ইউরোপ, জাপান ও চীনের ব্যাংকের কাছে একদিন তারা পেছনে পড়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের নেতৃত্বে চীন ছাড়ার যে নীতি তাতে যোগ দিতে জি-৭-এর ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করে, তাহলে ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা—ব্রিকসের এ দেশগুলো চীনের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, তার সুবিধাটা নিয়ে নেবে। সদস্যদেশগুলোর জিডিপি একসঙ্গে করলে ব্রিকস এখন বিশ্বে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। জি-৭-এর সঙ্গে ব্রিকসের ব্যবধানটা ক্রমেই বড় হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন—দুই দেশই এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে কাজের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রসংখ্যক নিয়োগদাতা বৃহৎ-সংখ্যক কর্মজীবীর ওপর আধিপত্য করে। যুক্তরাষ্ট্রের কাজের ক্ষেত্রের বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন। চীনের ক্ষেত্রে একটা হাইব্রিড ব্যবস্থা চালু রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন—দুটিই চলছে।
এ ধরনের ব্যবস্থায় নিয়োগদাতা শ্রেণি কর্মজীবী শ্রেণির থেকে অনেক বেশি সম্পদের মালিক। আর নিয়োগদাতা শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বিরোধ দুই দেশের শ্রেণিগুলোর মধ্যকার সংঘাতের ওপর নির্ভর করে। এক দেশের প্রতি অন্য দেশের নীতি কী হবে, তার নির্ধারকও এটি।
রিচার্ড ডি উলফ ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহার্স্টের অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনুবাদ মনোজ দে