২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যেদিন লক্ষাধিক সেনা নিয়ে ইউক্রেনের দিকে অগ্রসর হলো, সেদিনই বিশ্বে একটি ভূরাজনৈতিক ভূমিকম্প ঘটে গেছে। তারপর দুই বছর কেটে গেছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ এখনো চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই মহাদেশে এত বড় ও প্রলম্বিত যুদ্ধ আর কখনো হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে কোনো যুদ্ধে এত প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ আর কখনো হয়নি।
রাশিয়া এখন যা করছে, তা উনিশ শতকের কায়দায় সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের একটি ক্ল্যাসিক উদাহরণ। ইউক্রেন এখন যে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করছে, তা অতীতে অনেক দেশ ভোগ করেছে।
রাশিয়ার দিক থেকে এ যুদ্ধ কখনোই ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা, ন্যাটোর সম্প্রসারণ, রুশ ভাষাভাষীদের সুরক্ষা অথবা অন্য কোনো বানোয়াট অজুহাতের ওপর ভিত্তি করে চালানো হয়নি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অনবরত বলে আসছেন, ইউক্রেন নামে আলাদা দেশ বলে কখনোই কিছু ছিল না এবং ইউক্রেনীয় পরিচয়টি একেবারেই কৃত্রিম। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনীয় পরিচয়টি পশ্চিমাদের বানানো পরিচয়।
এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য একটি স্বাধীন দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, তাদের ভূমি কেড়ে নেওয়া এবং এমন একটি জাতির ওপর আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, যারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যের মালিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতীতে ঔপনিবেশিক শাসন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে, এমন অনেক জাতির কাছে রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিঃসন্দেহে পরিষ্কার হয়ে গেছে।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনের অভিঘাত ইউরোপের বাইরেও বহুদূর পর্যন্ত অনুভূত হচ্ছে। এই যুদ্ধ খাদ্যনিরাপত্তা ও জ্বালানির দামকে প্রভাবিত করছে। সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে ব্যাপক বিভ্রান্তি ও রাজনৈতিক অস্তিত্বশীলতা সংক্রমিত হচ্ছে। এই কম্পনপ্রবাহ সত্যিকার অর্থেই বৈশ্বিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুতিন ক্রমবর্ধমানভাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর প্রভাব সম্প্রসারিত করছেন। তিনি আফ্রিকায় তাঁর ভাড়াটে বাহিনী ভাগনার গ্রুপ মোতায়েন করেছেন, বিভিন্ন দেশে অভ্যুত্থান ঘটানোর মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন এবং ইউক্রেনে ফসলের মাঠ পুড়িয়ে দিয়ে, শস্যের গোলাগুলো ধ্বংস করে ও ইউক্রেনের আমদানির নৌপথ বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিমভাবে ক্ষুধার হুমকি সৃষ্টি করেছেন। এসবের মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক জবরদস্তি চালানোর মতো কাজ করছেন।
এ কারণে এই যুদ্ধ ও যুদ্ধের পরিণতি প্রতিটি দেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যুদ্ধে যদি রাশিয়ার জয় হয়, তাহলে দেশটি যে ভয়ানক বার্তা দেবে তা হলো, ‘জোর যার মুল্লুক তার’। তখন বিশ্বের প্রতিটি আগ্রাসনবাদী শক্তি রাশিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। আগ্রাসন করার পর যদি কোনো সাজা ভোগ করতে না হয়, তাহলে কেন শক্তিশালী দেশগুলো তাদের প্রতিবেশীকে দখল করবে না?
এ কারণে ইউক্রেনের জয়ের সঙ্গে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। এই যুদ্ধ কোনো অর্থেই ‘বাকি বিশ্বের সঙ্গে পশ্চিমের যুদ্ধ’ নয়। ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার অর্থ ‘পশ্চিমাপন্থী’ অবস্থান নেওয়া নয়; এটি যুদ্ধ ও সন্ত্রাসকে অস্বীকার করার নামান্তর। এটি ইউক্রেনীয়দের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতির পক্ষে দাঁড়ানো।
ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন একবিংশ শতাব্দীতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে অভিন্ন মত পোষণ করে, যা পুতিনের রাশিয়ার ঠিক বিপরীত। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি জবরদস্তি করা, ঘুষ লেনদেন করা ও ভয় দেখানো নয়। তার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক আইন, সম্মান ও পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের ওপর ভিত্তি করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড়িয়ে আছে।
যুদ্ধ যখন তৃতীয় বছরের দিকে গড়াচ্ছে, তখন আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী শক্তির কাছে আমরা যে বার্তাটি পৌঁছে দিতে চাইব, সেটি হলো—একুশ শতকে আমরা আগ্রাসনকে কোনোভাবেই পুরস্কৃত করতে কিংবা কারও দ্বারা পুরস্কৃত হতে দিতে পারব না। এর বদলে আমরা তার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করব। এই ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের কার্যকর সমর্থন দরকার।
দ্রুত এই যুদ্ধের অবসান ঘটানো এবং গোটা মহাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের চেয়ে বেশি আগ্রহ আর কারও নেই। এই শান্তি অর্জনের জন্য ইউক্রেন ইতিমধ্যে একটি ১০ দফা শান্তি ফর্মুলা প্রস্তাব করেছে, যেটি কিনা ইউরোপীয় ইউনিয়ন পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। এই প্রস্তাবে শুধু শত্রুতার অবসান ঘটানোর বিষয়টি উঠে আসেনি, বরং তার পাশাপাশি তাতে খাদ্যনিরাপত্তা, পারমাণবিক নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা, জ্বালানি নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও মানবতাকে শক্তিশালী করা জাতিসংঘ সনদগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইউক্রেনের এই ১০ দফা শান্তি ফর্মুলাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ শান্তি প্রস্তাব। আমরা বিশ্বের সব দেশকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে এবং ফর্মুলাটিকে কাজে পরিণত করতে সহায়তা করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। ইউক্রেন বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে একটি বৈশ্বিক শান্তি সম্মেলন করছে এবং কার্যকরভাবে এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ সনদের ওপর ভিত্তি করে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা নেতারা একসঙ্গে কাজ করবেন। বিশ্বব্যাপী সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বকারী সেই প্রস্তাব তখন রাশিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হলে রাশিয়ার তাতে সম্মতি দেওয়া ছাড়া পথ থাকবে না।
যুদ্ধ যখন তৃতীয় বছরের দিকে গড়াচ্ছে, তখন আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী শক্তির কাছে আমরা যে বার্তাটি পৌঁছে দিতে চাইব, সেটি হলো—একুশ শতকে আমরা আগ্রাসনকে কোনোভাবেই পুরস্কৃত করতে কিংবা কারও দ্বারা পুরস্কৃত হতে দিতে পারব না। এর বদলে আমরা তার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করব। এই ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের কার্যকর সমর্থন দরকার।
দিমিত্রো কুলেবা ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জোসেপ বোরেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসির হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ