মিহির ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো ছাত্র। এ নিয়ে তার মা-বাবা বা শিক্ষকদের কখনো বেগ পোহাতে হয়নি। নিজের পড়া নিজেই শেষ করেছে; প্রতিটি বিষয় মনোযোগ দিয়ে পড়া ও পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা নিয়ে তার মাতা-পিতার মধ্যে সব সময়ই একপ্রকার সন্তুষ্টি কাজ করেছে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন মিহির চাকরিজীবনে প্রবেশ করে।
অফিসে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা নানা বয়সের মানুষ কাজ করে। তাদের বেড়ে ওঠা, পারিবারিক মূল্যবোধ বা পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করার পদ্ধতি ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। হুট করে এসব পার্থক্যের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল মিহিরের।
এর মধ্যে একদিন মিহিরের অফিসের বস তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এমন ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায় কী করতে হবে বুঝতে না পেরে মিহিরও বসের সঙ্গে রাগারাগি করে অফিস থেকে বের হয়ে আসে এবং অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাকে নিয়ে তার পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।
কিছুদিন চেষ্টার পর মিহির আবার আরেকটি অফিসে কাজে যোগদান করে। এখানেও বাকি মানুষদের সঙ্গে তার মানিয়ে চলা নিয়ে অসুবিধা হতে থাকে। তার মা-বাবা একদিন বসে আলাপ করতে থাকেন, আসলে সমস্যাটা হচ্ছে কোথায়?
মিহিরের মতো সমস্যা আসলে আমাদের সবারই হতে পারে। সমাজের অন্যান্য ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের সঙ্গে মানিয়ে চলার এই বিষয়কে বিশেষজ্ঞরা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা ইআই) বলে সংজ্ঞায়িত করেন।
একসময় ধারণা করা হতো যে মানুষের আইকিউ (বুদ্ধিমত্তা) তার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তবে ইদানীং বিশেষজ্ঞরা এ ধারণা থেকে সরে এসেছেন। তারা মনে করছেন, ইআই জীবনে সফল হওয়ার ক্ষেত্রে আইউকিউয়ের চেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে।
এমনকি চাকরির ক্ষেত্রেও অন্যদের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে প্রায় ৭১ শতাংশ কর্মী কারিগরি দক্ষতার চেয়ে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা কী?
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। জন মেয়ার ও পিটার স্যালোভে নামের দুই গবেষক ১৯৯০ সালে প্রথম এই ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স শব্দটি ব্যবহার করেন। আর মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল গোলম্যান বিষয়টিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বলতে বোঝানো হয় নিজের ও অন্যের আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে বুঝতে পারার পাশাপাশি, প্রয়োজনের সময় তা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করার দক্ষতা থাকা।
অন্যভাবে বলা চলে, নিজেকে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা, বাকিদের আবেগের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে তাদের সঙ্গে যথাযথ আচরণ করা এবং নিজের অনুভূতির সঙ্গে মিল রেখে আশপাশের পরিস্থিতি অনুযায়ী যথার্থভাবে সাড়া দেওয়ার সক্ষমতাই হচ্ছে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার মূল উপাদান
ড্যানিয়েল গোলম্যান আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার চারটি উপাদান চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে দুটি নিজের সঙ্গে ও দুটি অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কিত। একই সঙ্গে, চারটি উপাদানের মধ্যে দুইটি আবার সচেতনতার সঙ্গে এবং বাকি দুইটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত।
গোলম্যানের উল্লেখ করা চারটি উপাদান হচ্ছে আত্মসচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহমর্মিতা বা সামাজিক সচেতনতা এবং সামাজিক দক্ষতা বা সম্পর্কের ব্যবস্থাপনা। অনেক মনোবিজ্ঞানী আবার এর সঙ্গে পঞ্চম উপাদান হিসেবে প্রেরণা বা উদ্দীপনাকে যুক্ত করেন।
সব মিলিয়ে মানুষের আবেগ-অনুভূতির ক্ষেত্রে এই পাঁচ উপাদান নিয়ে গড়ে ওঠে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা।
আত্মসচেতনতা বলতে বোঝানো হয় নিজের আবেগ-অনুভূতি বুঝতে পারার মাধ্যমে নিজেকে মূল্যায়ন করার সক্ষমতা। আত্মনিয়ন্ত্রণ বলতে বোঝায় নিজের অতি আবেগগুলো (রাগ, হিংসা, জেদ ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ক্ষমতা।
সহমর্মিতা হচ্ছে অপর মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা, তার পরিস্থিতি বুঝতে সক্ষম হওয়া, তার চাহিদা, প্রত্যাশা বা আবেগের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারা।
সামাজিক দক্ষতা হচ্ছে নিজের আবেগ যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতা ও অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারা; নিজের বক্তব্য তুলে ধরা ও অন্যের বক্তব্য বা মতামত বিবেচনায় নিয়ে সামাজিকভাবে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার দৃষ্টিভঙ্গি।
আর প্রেরণা হলো কোনো ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। কর্মোদ্যমী হওয়া, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা, দক্ষতা বাড়াতে সচেষ্ট হওয়া, নতুন কিছু শেখা বা দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাওয়া হচ্ছে প্রেরণা বা উদ্দীপনার বহিঃপ্রকাশ।
শৈশবেই আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ
মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, মানুষের সফলতার পেছনে আইকিউ ২০ শতাংশ ও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ৮০ শতাংশ দায়ী। একই সঙ্গে, পরিচর্যার মাধ্যমে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ সম্ভব। মানুষ খুব ছোটবেলায়ই নিজের আবেগ-অনুভূতিগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়।
এ সময় তাদের নিজেদের অনুভূতি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারা ও অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারার মতো সক্ষমতা তৈরি হয়। তবে অনেক সময় শিশুরা নিজের আবেগ ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না, সে সময় তাদের আবেগ প্রকাশের বিষয়ে যথাযথ ধারণা দেওয়াই হতে পারে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বিকাশের প্রথম ধাপ।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশে শিক্ষক ও অভিভাবকদের ভূমিকা
প্রত্যেক শিশুই আলাদাভাবে চিন্তা করে, অনুভব করে, এমনকি তাদের আবেগ প্রকাশের ভঙ্গিও অনেক আলাদা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
দরকারে আবেগ-অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করা, আবেগ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তা অনুশীলন করা, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ইত্যাদি নিয়ে শিশুদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা যেতে পারে।
গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিশু পাঁচ বছরের মধ্যে শেয়ার করা, সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হওয়া ও অন্যের নির্দেশনা বুঝতে পারার মতো দক্ষতা অর্জন করে, তাদের পড়াশোনা শেষ করা ও ২৫ বছর বয়সের আগেই পূর্ণকালীন চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
বিশেষ করে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সামাজিকতা, ভিন্ন মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, নেতৃত্ব দেওয়া, দলগতভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করার মতো বিষয়ে দক্ষতা তৈরির মাধ্যমে শিক্ষকেরা শিশুদের মধ্যে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটাতে পারেন।
প্রাথমিকভাবে পরিবার থেকেই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে শিশুকে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তায় দক্ষ করে তুলতে হলে পরিবারকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে। মনোযোগ দিয়ে শিশুদের কথা শোনা, কোন আবেগকে কীভাবে প্রকাশ করতে হবে, সে বিষয়ে ধারণা দেওয়া থেকে বিষয়টি শুরু করা যায়।
প্রয়োজনে আবেগের প্রকাশ সম্পর্কে নিজের ব্যক্তিগত উদাহরণ দেওয়া বা গল্পের আকারে তা বোঝানো যেতে পারে। একইভাবে শিক্ষকেরাও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
বিশেষ করে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সামাজিকতা, ভিন্ন মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, নেতৃত্ব দেওয়া, দলগতভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করার মতো বিষয়ে দক্ষতা তৈরির মাধ্যমে শিক্ষকেরা শিশুদের মধ্যে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটাতে পারেন।
আর পাঠ্যক্রমে এটি যুক্ত করা গেলে দেশের সব শিক্ষার্থী একযোগে এ বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে। এতে করে আমরা একটি যুগোপযোগী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রয়াসে অনেক ধাপ এগিয়ে যাব।
ভবিষ্যৎ সাফল্যে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা
ট্যালেন্টস্মার্টইকিউ পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেকোনো ধরনের কাজে ৫৮ শতাংশ সফলতার পেছনে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে অবদান রাখে।
বিশেষ করে, নিজের বক্তব্য পরিষ্কারভাবে অপরের সামনে তুলে ধরা, অন্যের আবেগ ও বক্তব্য সম্পর্কে নিজে পুরোপুরি বুঝতে পারা, নেতৃত্ব ও দলগত কাজের দক্ষতা, নতুন মানুষ বা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, যেকোনো বাধা সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা মোকাবিলা করার দক্ষতা কাজের জায়গায় মানুষকে এগিয়ে রাখে।
আর শৈশবেই আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটানো গেলে কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। তবে এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন, যদি ইআই নিয়ে কেউ কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন, তিনি চাইলে প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে সেই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
শিশুদের ভবিষ্যৎ সাফল্যের ক্ষেত্রে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে প্রথমে পরিবারকে এবং পরে স্কুল ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন (আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা) নিশ্চিত করা গেলেই ভবিষ্যতে তাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
কুমকুম হাবিবা জাহান হেড অব জুনিয়র স্কুল, গ্লেনরিচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল