একটা সময় ছিল যখন ঈদ মানে নতুন জামা, নতুন জুতা, সালামির টাকা। আর বাসায় পোলাও কোরমা রান্না, দোকানে গিয়ে কোক ও প্যাটিস কিনে খাওয়া, আর দলবেঁধে পাড়ার ছেলেমেয়েরা এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে ঘুরে সেমাই জর্দা খাওয়া। ঈদ রাতের বড় আনন্দ ছিল বিটিভিতে আনন্দমেলা ও ঈদের নাটক দেখা।
ঈদের পরেরদিন টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখা। তখন সময়টা ছিল ৭০ এবং ৮০ দশকের পুরোটা সময় এবং নব্বই দশকের প্রথম ভাগ।
কাক ভোরে উঠে বাসার মেয়েরা বিশেষ করে মায়েরা চুলায় হাড়ি চড়াতেন, যেন গরম গরম নাস্তা খেয়ে পুরুষেরা নামাজে যেতে পারেন। অথবা নামাজ পড়ে এসেই নাস্তাটা পেয়ে যান। বাসায় কাজের জন্য সহকারী থাকলেও সব ঈদ স্পেশাল রান্না মায়েরা করতেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরগুলোতেও সেদিন নাস্তার টেবিলে থাকতো খাস্তা পরোটা, জর্দা সেমাই, দুধ বা লাচ্ছা সেমাই, টিকিয়া কাবাব বা গোশত। ঈদ পর্ব ছাড়া এমন ভালো খাবার তেমন করে আমাদের খাবার টেবিলে আসতো না।
সেই সময় ছিল না পত্রিকাগুলোর ঈদ স্পেশাল রান্নার ম্যাগাজিন বা বিশেষ পাতা, টিভিতে হতো না রান্নার অনুষ্ঠান বা ছিল না ইউটিউব চ্যানেল। ফলে ঈদ রেসিপিও মা-খালাদের নিজেদের তৈরি বা পারিবারিক রান্নাঘরে শেখা। পরিবারের সব সদস্য একসাথে নাস্তার টেবিলে বসতেন। এরপর যে যার মতো লুকিয়ে রাখা নতুন কাপড় পরে পাড়া বেড়াতে বের হয়ে যেতো।
সেসময় ঈদ উপলক্ষে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাড়িগুলোতে কয়েকদিন আগে থেকেই ঘর গুছানোর একটা হইচই পড়ে যেতো। জানালার আটপৌড়ে পর্দাগুলো মাড় দিয়ে ধুয়ে ইস্তিরি করে নতুন করা হতো। বসার চেয়ারের শতবার ব্যবহৃত কভারগুলোকে ধুয়ে চকচকে করার চেষ্টা করা হতো। মায়েদের অনেক অনুরোধের পরেও বাবারা পর্দা বা চেয়ারের নতুন কভার বানানোর ব্যয় সংকুলান করতে পারতেন না।
এরপরেও পরিবারগুলোতে ঘরদুয়ার ঝাড়পোছ করা হতো, নতুন ফুলদানি বা কিছু গ্লাস বাটি কেনা হতো। আসলে ঈদ উপলক্ষে মায়েরা চাইতেন সংসারের জন্য দরকারি কিছু জিনিষ কিনে ফেলতে। কখনো বাজেটে হতো, কখনো হতো না। শো-কেস থেকে নামানো হতো বহুদিন ধরে যত্নে তুলে রাখা মায়েদের প্রথমদিকের সংসারের কাপ-পিরিচ বা প্লেটগুলো। এই তৈজসপত্রগুলো বছরে শুধু এই দুই ঈদেই শো-কেস বা আলমারি থেকে বের হতো।
ঈদে নতুন জামা-কাপড়, জুতা বা অন্য কিছু কেনা এবং পেট ভরে মিঠাই-মন্ডা ও পোলাও-কোর্মা খাওয়াটা হচ্ছে একটা আনন্দ উদযাপণ। এই আনন্দ তখনই পূর্ণ হবে, যখন আমাদের চারপাশের মানুষ সেই আনন্দে কিছুটা হলেও অংশ নিতে পারবেন। আমরা কি পারি না ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে? আমাদের সন্তানরা তাদের মতো করে আনন্দ উপভোগ করুক, সেই সাথে যেন তাদের মনে আবেগ ভালবাসাটাও ভাগ করে নিতে শেখে।
ঈদে পরিবারের সবাই এক সাথে থাকবে এটাই ছিল নিয়ম। সবাই দল বেঁধে আত্মীয় স্বজনদের বাসায় যাওয়া, খোঁজখবর নেয়া, ঈদ উপহার বিনিময় করা, ঈদ মোবারক লিখে হাতে কার্ড বানিয়ে বন্ধুদের দেওয়াই ছিল রীতি। বড়দের সালাম করা ও অল্পবিস্তর সালামি পাওয়া ছিল রেওয়াজ।
অথচ জীবনের এই সময়টা, সময়ের ছবিটা কত দ্রুত পাল্টে গেল নব্বই দশকের শেষ দিক থেকে।
মানুষের হাতে টাকার যোগান বাড়লো। মধ্যবিত্ত ক্রমশ উচ্চ মধ্যবিত্ত হয়ে উঠলো। ঈদ পালনে স্বাচ্ছন্দ্য ও ঔজ্জল্য বাড়লো কিন্তু আগের সেই আবেগ ও উচ্ছাস কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মানুষের হাতে টাকা এলো বলে ঈদের আয়োজনে ব্যয় বাড়লো, সংসার খরচে যোগ হলো নতুন পর্দা কেনা, আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র কেনা।
বাচ্চারা বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্য আত্মীয় বন্ধুদের কাছ থেকে ৪/৫ টি করে পোশাক পেলো, পেলো একের অধিক জুতা, সাথে সাজসজ্জার জিনিস। ফলে আমাদের পরের কয়েকটি প্রজন্মের কাছে নতুন উপহার পাওয়ার আনন্দ ও উত্তেজনাও কমে যেতে থাকলো। এখনকার বাচ্চারা উপহার পাওয়া নিয়ে আগ্রহ ও বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়েছে বলা যায়।
বাসায় রান্না করা পোলাও-কোর্মার প্রতি মোহ কমতে থাকলো শিশু ও তরুণদের। সকালের নাস্তার পরোটা-সেমাইও কেমন যেন জনপ্রিয়তা হারালো। ঈদ উপলক্ষে ঘরে আগের মতো নাস্তা বানানোও হয় না, সেসবের প্রতিও নতুন প্রজন্মের আগ্রহ থাকল না। বাচ্চারা এখন এতোটাই আদরে সোহাগে বড় হয় যে, এইসব পোলাও, কোর্মা, মাংস, পরোটা সেমাই মুখে নিতেই চায় না তারা। তাছাড়া অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি হওয়ায়, অনেক পরিবারের সারা বছরই ভালো ভালো খাবার খেয়েই থাকে। ফলে আলাদা করে ঈদের দিন এসব খাবার নিয়ে উচ্ছ্বাস কাজ না করারই কথা।
আগে আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেমাই জর্দা নানা প্রকার নাস্তা খেতাম। এখনকার প্রজন্মের কাছে রেষ্টুরেন্টে বসে হইচই করে বার্গার-পিৎজ্জা খাওয়াটাই বেশি আনন্দের। আর তাইতো ঈদের দিনগুলোতে ঢাকার অধিকাংশ ফার্ষ্ট ফুড শপ ও রেষ্টুরেন্ট থাকে পূর্ণ। ঈদে কেনাকাটার জৌলুস ও আনন্দ বাড়লেও ঈদকে কেন্দ্র করে আবেগ কমে গেছে।
তবে এটাও ঠিক যে আমরা ৪৮/৪৫ বছর আগে যেভাবে জীবনকে ও ঈদকে দেখেছি, আজকালদিনের শিশু-কিশোররা সেভাবে দেখবে না। তাদের রুচি, পছন্দ, চাহিদা ও প্রাপ্তি সব পাল্টে গেছে দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে। এরা অনেক কিছু বেশি জানে, হাল ফ্যাশানের খোঁজ খবর রাখে। ফলে তাদের আবেগ ও পছন্দের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে।
এখন মানুষের মধ্যে পরিবার পরিজন ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দেশে বিদেশে বেড়ানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এই পর্যটকদের কেন্দ্র করে দেশে বেড়েছে পর্যটন ব্যবসা। আমরা ঈদে গ্রামের বাড়ি যেতাম। কারণ ঈদে এর বাইরে যে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যায়, তা কল্পনার মধ্যেও ছিল না করো।
সংসার জীবন শুরু করার পর থেকে প্রতিবছর ঈদ এলেই আনন্দের চেয়ে দায়িত্ব যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় পরিবার পরিচালনাকারী ব্যক্তির কাছে। যারা সংসার চালান, তারা পরিবারের প্রতিটি মানুষের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও, চেষ্টা চালিয়ে যান যেন, সবার সব চাহিদা পূরণ করতে পারেন। তারা বুঝতে পারেন, তাদের কালের ঈদ ও এইকালের ঈদ উদযাপণের সবকিছুতেই অনেক পার্থক্য এসেছে।
বাসায় কী কী আইটেম রান্না হচ্ছে, এর চাইতেও এখনকার শিশু তরুণরা বেশি আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় যে, শহরে কোন ক্যাফেটা ঈদে কী অফার দিচ্ছে? মা–বাবা ঈদে কতটাকা হাতখরচ দেবেন? দাম যাই হোক ট্রেন্ডি জামাকাপড়টা কেনা হলো কিনা, বাবার গাড়িটা নিয়ে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যেতে পারবে কিনা? এখন ঈদে জামা–কাপড়ের পাশাপাশি শিশু কিশোরদের চাহিদা দামি স্মার্টফোন বা অন্য কোনো গ্যাজেট বা কোনো ব্র্যান্ডের ব্যাগ, কেডস বা কাপড়।
যাদের অভিভাবকের হাতে বেশুমার টাকা, তাদের পক্ষে কেনাটা সমস্যা হয়না। কিন্তু যাদের পরিবারের নির্ধারিত আয় কিন্তু সন্তানের চহিদা বেশি, তাদের জন্য ঈদটা আর আনন্দের থাকে না, হয়ে যায় চাপের। আমাদের সময়ের ঈদের সঙ্গে এইসময়ের ঈদের এটাও একটা বড় পার্থক্য। আগে ঈদে কিছু পেলেই হতো। গজ কাপড় কিনে এনে বাসায় সেলাই করে ভাইবোনদের একরকম জামা বানিয়ে দেয়া হতো। কখনো কখনো দর্জিবাড়িতেও জামা বানাতে দেয়া হতো।
কিন্তু আজকাল তাদের মনমতো উপহার কিনে দিতেই হবে। ৩/৫ মার্কেট ঘুরেও বাচ্চারা তাদের কাংখিত জামাকাপড়, জুতা পছন্দ করতে পারছে না। বাবা মা গলদঘর্ম হচ্ছেন কিন্তু তাও চাইছেন সন্তান যেন পছন্দ মতো একটি জিনিষ কিনে ফিরতে পারে। আমাদের সময় মূলত রোজার ঈদেই কেনাকাটা হতো বেশি, জামাকাপড়ও দেয়া হতো এই ঈদেই। কোরবানি ঈদে শুধু মাংস খাওয়াই ছিল ঈদ উপহার।
যতোই দিন যাচ্ছে, উপলব্ধি করছি বর্তমান সময়টা আমাদের প্রায় আবেগহীন করে তুলেছে। হয়তো এমনটাই যুগের পরিবর্তন। এমনকি দায়িত্বপালনের দিক থেকেও মানুষ হয়ে উঠছে কৃপণ। শুধু ঈদ বা উৎসব বলে নয়, জীবনের সবক্ষেত্রে। ভালবাসা হয়ে পড়েছে দিবসকেন্দ্রিক ও সামাজিক মাধ্যমভিত্তিক।
এমন একটা সময়ে ঈদ এসেছে আমাদের জীবনে, যখন আন্তর্জাতিক বিরোধ, অর্থনীতির চাপ, মুদ্রাস্ফীতি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস ও জ্বালানির উচ্চমূল্য, প্রচন্ড গরম ঈদের আনন্দ ও প্রাপ্তি কমিয়ে দিয়েছে বহুগুণ। বাড়ি ভাড়া দিয়ে, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ কেনার খরচ যুগিয়ে, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, ওষুধ, বাচ্চার দুধ কিনতে কষ্ট হচ্ছে অনেক মানুষের। আমরা যদি নিজ নিজ পরিবার ও আশেপাশের মানুষের দিকে দৃষ্টি দেই, দেখবো এদের অনেকেই খুব কষ্টের মধ্যে আছেন কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেন না।
ঈদে নতুন জামা-কাপড়, জুতা বা অন্য কিছু কেনা এবং পেট ভরে মিঠাই-মন্ডা ও পোলাও-কোর্মা খাওয়াটা হচ্ছে একটা আনন্দ উদযাপণ। এই আনন্দ তখনই পূর্ণ হবে, যখন আমাদের চারপাশের মানুষ সেই আনন্দে কিছুটা হলেও অংশ নিতে পারবেন। আমরা কি পারি না ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে? আমাদের সন্তানরা তাদের মতো করে আনন্দ উপভোগ করুক, সেই সাথে যেন তাদের মনে আবেগ ভালবাসাটাও ভাগ করে নিতে শেখে।
কারণ যে উৎসব আয়োজনের সাথে মা-বাবা হারা সন্তান আর অসহায় মানুষের যোগ নেই, সেই উৎসব আসলে, উৎসব নয়, সেটা হয় শুধু নিছক উদযাপণ। কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।’
শাহানা হুদা যোগাযোগ কর্মী