২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর বিশ্বের অনেক পণ্ডিত ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কেউ কেউ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, বিশ্বের নানা দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তবে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল বাদে বিশ্বের বাকি অঞ্চলে সামরিক অভ্যুত্থান বিরল ঘটনা হিসেবেই রয়ে গেছে। গৃহযুদ্ধের ঘটনাও খুব একটা নেই। তবে সামরিক অভ্যুত্থান না থাকলেও বেসামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশের গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে।
শীতলযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মূলত তিন ধরনের কায়দায় বেসামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। তবে সেসব নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। ২০২৫ সালের শুরুতেই ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসতে পারেন। এ আশঙ্কা যতখানি বিচলিত করার কথা, সেটি নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নই আমরা।
গণতন্ত্রকে পিছিয়ে রাখার প্রথম মডেল দৃষ্টান্তযোগ্যভাবে বাস্তবায়ন করেছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান। ২০১০ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে একটি কালাকানুন পাস করেছেন। ওই আইনের মাধ্যমে ওরবান ও তাঁর দল হাঙ্গেরির প্রতিটি সংবাদমাধ্যমকে হাতের মুঠোয় নিয়েছে। এসব সংবাদমাধ্যম সমকামী আন্দোলনকর্মী ও অভিবাসীদের জাতীয় হুমকি হিসেবে দেখাচ্ছে এবং ওরবানকে জাতীয় ত্রাতা হিসেবে চিত্রায়িত করছে। ওরবান ইউক্রেন যুদ্ধের মতো আঞ্চলিক ইস্যুকেও কাজে লাগিয়ে রাশিয়া এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন উভয়ের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করছেন।
সর্বোপরি ওরবানের দল ফাইডেজ হাঙ্গেরির নির্বাচনী আইন এমনভাবে তৈরি করেছে যাতে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
বেসামরিক অভ্যুত্থানের এই মডেল সরাসরি সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করে না। এই মডেলে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার ভারসাম্যকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে গোটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেই কর্তৃত্ববাদী করে তোলা হয়।
গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণের দ্বিতীয় মডেলটি ইদানীং অনেক দেশেই দেখা যাচ্ছে। এই মডেলের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া ও ড্যানিয়েল ওরতেগার নিকারাগুয়া। এই মডেলে একটি নাটকীয় জাতীয় সংকট জিইয়ে রাখা হয়। সেই সংকট কোনো আন্দোলনের জন্ম না দিয়ে একজন লৌহকঠিন শাসকের জন্ম দেয়। জনমনে সেই শাসককে একজন রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
এই মুহূর্তে রাশিয়ার মানুষকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধারণা দেওয়া হচ্ছে, আমেরিকার দিক থেকে যে হুমকি আসছে, তা রাশিয়ার অর্থনীতি এমনকি সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সেই হুমকি থেকে গোটা জাতিকে এখন বাঁচাতে পুতিনের বিকল্প কোনো নেতা নেই।
তবে পুতিন জনসমর্থনের চেয়ে তাঁর দেশের অভিজাত ক্ষমতাধর গোষ্ঠীকে হাতে রাখতে ব্যস্ত আছেন। রাশিয়ায় বিনিয়োগ করা পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর অর্থ আত্মসাৎ করে তিনি সেই গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখছেন। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা ঠেকাতে তিনি জনগণের ওপর নির্ভর না করে ঠগি বা দুর্বৃত্তদের ওপর নির্ভর করছেন।
ট্রাম্প যে মডেলটি অনুসরণ করে এগোচ্ছেন তা ভিক্তর ওরবান কিংবা পুতিনের মডেল নয়। তিনি ওরবানের মতো গণমাধ্যমকে হাতের মুঠোয় না নিয়ে এবং পুতিনের মতো অভিজাত গোষ্ঠীকে চূড়ান্ত সুযোগ-সুবিধা না দিয়েই বেসামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে চান। তিনি আমেরিকার রক্ষণশীল নাগরিকদের মধ্যে অভিবাসী ও অর্থনৈতিক অপচয়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভয় ধরিয়ে দিতে পেরেছেন।
এই মডেলে কর্তৃত্ববাদী শাসক ভিক্তর ওরবান নিজের দল ও জনতুষ্টিবাদী জনতার ওপর নির্ভর করেন না। এই মডেলের স্বৈরাচার শাসক পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের সমন্বয়ে একটি চক্র গড়ে তোলেন। সেই চক্র ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। প্রয়োজনে তাঁরা গুণ্ডাবাহিনীকেও নিজের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
ট্রাম্প যে মডেলটি অনুসরণ করে এগোচ্ছেন তা ভিক্তর ওরবান কিংবা পুতিনের মডেল নয়। তিনি ওরবানের মতো গণমাধ্যমকে হাতের মুঠোয় না নিয়ে এবং পুতিনের মতো অভিজাত গোষ্ঠীকে চূড়ান্ত সুযোগ-সুবিধা না দিয়েই বেসামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে চান। তিনি আমেরিকার রক্ষণশীল নাগরিকদের মধ্যে অভিবাসী ও অর্থনৈতিক অপচয়সহ বিভিন্ন ইস্যুতে ভয় ধরিয়ে দিতে পেরেছেন।
ট্রাম্প সমর্থকেরা মনে করছেন, আমেরিকা ভিন্ন সংস্কৃতির অভিবাসীদের চাপে তার মৌলিক চরিত্র হারাচ্ছে। একই সঙ্গে মিত্র দেশগুলোকে মাত্রাতিরিক্ত অর্থসহায়তা দেওয়ার কারণে আমেরিকান জনগণের পরিষেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য ট্রাম্প নিজেকে ত্রাতা হিসেবে তুলে ধরেছেন।
আশঙ্কার বিষয়, হলো ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচিত হলে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বেসামরিক অভ্যুত্থানকারী শাসকদের তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দেবেন। পুতিন এবং ওরবানের মতো শাসকেরা আরও শক্তিধর স্বৈরাচার হয়ে উঠবেন।
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
জেরেমি অ্যাডেলম্যান প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল হিস্ট্রি ল্যাব-এর পরিচালক