একটা বিশ্ববিদ্যালয় তার কোন পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসে? বৈশ্বিক জ্ঞান-দর্শন-বিজ্ঞানের ভান্ডারে বিশ্ববিদ্যালয় কী যুক্ত করতে পেরেছে, তা দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়। সমাজে বিদ্যমান নানা মত-পথের মিথস্ক্রিয়া আর তর্ক-বিতর্কের একেকটা কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়।
ধরে নিই যে গরিব দেশে শিক্ষার পেছনে খুব বেশি ব্যয় করার সক্ষমতা আমাদের নেই, অল্প খরচে বেশি শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার চাপও রয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক মানদণ্ডে পিছিয়ে আছে। কিন্তু তাই বলে কি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অবাধ অপরাধের ক্ষেত্র হয়ে উঠবে? শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা থাকবে না?
বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪। নতুন আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কিন্তু ধর্ষণ, নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, পিটিয়ে হত্যা, গেস্টরুম-গণরুম কালচার, চাঁদাবাজি, ক্যাম্পাসে বাস আটকে রেখে চাঁদাবাজি, ক্যান্টিনে ফাউ খাওয়া, বিরোধী মতের ছাত্রদের পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করে দেওয়া, মাদক সেবন ও মাদকের ব্যবসা, গবেষণাপত্র চুরি করে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া, ভর্তি পরীক্ষার টাকা ভাগাভাগি, উন্নয়ন প্রকল্পে ঘুষ কেলেঙ্কারি, নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি—আর এসব ঘটনায় ছাত্র বিক্ষোভ এবং সেই বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের দমন–পীড়ন, এসব যখন খবরের শিরোনাম হতে থাকে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আবাসিক হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের যে অভিযোগ উঠেছে, তা একই সঙ্গে অসংখ্য প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগের ভিত্তিতে এবং শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক অসন্তোষের মুখে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে।
গ্রেপ্তার করেছে মূল অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতা মোস্তাফিজুর রহমানকে। ভুক্তভোগীর স্বামীকে আটকে রাখা ও মোস্তাফিজকে পালাতে সহযোগিতা করায় আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিন্ডিকেট সভা ডেকে সাবেক ও বর্তমান ছয় শিক্ষার্থীর সনদ স্থগিত করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার জন্য বাইরের লোকদের প্রবেশ সীমিত করা, অছাত্রদের হল থেকে বের করে দেওয়াসহ ত্বরিত পদক্ষেপ এসেছে। ছাত্রলীগও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে।
এই যে ভয়াবহ একটা অপরাধ ঘটে যাওয়ার পর সাড়া দেওয়া, তার যদি ছিটেফোঁটা সক্রিয়তাও স্বাভাবিক সময়ে দেখা যেত, তাহলে ক্যাম্পাসগুলোয় নিপীড়ন-নির্যাতন, খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা কি ঘটতে পারত? এই জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসেই ছাত্রলীগ নেতা জসিমউদ্দিন মানিকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এবং সেই অভিযোগকে কেন্দ্র করে ছাত্রবিক্ষোভের পরও মানিককে রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কোমর বেঁধে নামতে দেখেছি। একটা অপরাধের দায়মুক্তি কীভাবে আরও সব অপরাধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়, তার দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক ঘটনা।
অভিযুক্ত মোস্তাফিজ ছাত্রলীগের নেতা। তাঁর ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে আরও বছর দুই আগে। অথচ দিব্যি হলের সিট দখল করে থাকছিলেন তিনি। প্রথম আলোর খবর বলছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও হলে থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা হাজারের বেশি, যাঁদের সিংহভাগই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত। প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা যখন হলে সিট না পেয়ে বাইরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, সে সময় এই দখল করা সিটে বাইরের লোকজনও এসে থাকছেন।
মোস্তাফিজ মীর মশাররফ হলের ৩১৭ নম্বর যে রুমটাতে থাকতেন, সেখানে মাঝেমধ্যেই ৪৫ বছর বয়সী মামুনুর রশীদ মামুন (ধর্ষণকাণ্ডের আরেক অভিযুক্ত) এসে থাকতেন। সমকাল–এর খবর জানাচ্ছে, কক্ষটি মাদক বেচাকেনার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় ‘একের পর এক অপকর্ম, প্রশাসন নির্বিকার’ শিরোনামে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা পড়লে আঁচ করা যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কতটা অপরাধের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কতটা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নারী নিপীড়ন, ধর্ষণ, যত্রতত্র মাদক সেবনের মতো অপকর্মে জড়াচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক শামসুজ্জামান ও আবদুল্লাহ আল মামুন ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে পান, কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন করছেন অনেকে। কথা বলে জানা যায়, তাঁদের বেশির ভাগই এসেছেন সাভার-আশুলিয়া এলাকা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গেই তাঁদের সখ্য রয়েছে।
এই অসুস্থ ও অপরাধমূলক পরিবেশে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ ছাত্র নিপীড়নের ঘটনা না ঘটার কোনো কারণ নেই। ভুক্তভোগী নারী ভয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সাহস করে নীরবতা ভেঙে অভিযোগ জানিয়েছেন বলেই দেশের মানুষ জানতে পারছেন ভয়াবহ এসব অপরাধের খবর। এই নিরাপত্তাহীন পরিবেশে যে কেউ যেকোনো সময়ই আক্রান্ত ও নিপীড়িত হতে পারেন। প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে অবাধ অপরাধের ক্ষেত্র বানাল কারা?
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি জানার কথা বলছিলাম ‘নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের’ সংগঠক ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হাসিব জামানের সঙ্গে। জামান বলছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব জাঁকালোভাবেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখায় অভিযোগ দেওয়ার পরও সেগুলোর বিচার করা হচ্ছে না। এই অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে, যাঁদের অধিকাংশই এখন অছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযোগগুলো ধামাচাপা দেওয়ার কারণেই তাঁদের কাছে এই ধারণা জন্ম হয়েছে যে যেকোনো কিছু করেই পার পাওয়া যায়। তিনি বলছিলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি এখন এমন যে নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টাই এখন তাঁদের কাছে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
একজন মানিকের জন্ম কিংবা মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে এই যে গুরুতর অভিযোগ, সেটা কি এক দিনে হয়েছে? দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সংগঠন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নাগরিক সমাজ সবার চোখের সামনেই আর সবার নীরব-সরব সম্মতিতেই এসব অপরাধ, অপকর্ম ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তার কারণেই ক্যাম্পাসগুলো নিপীড়নের কেন্দ্র ও অপরাধের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নীলোর্মির ভাষ্যে সেই বাস্তবতাটাই বেরিয়ে এল। তিনি বলছিলেন, প্রাক্তন ছাত্র বলেন, বর্তমান ছাত্র বলেন কিংবা প্রশাসনের অংশ বলেন—তাদের একটা শক্তিশালী নেক্সাস গড়ে উঠেছে। তারা মনে করে যেকোনো কিছু ঘটিয়েই পার পাওয়া সম্ভব। এই সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে। তার কারণ হলো, ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক বলয়ের যে ছাত্রনেতা, তাঁরা এখন উপাচার্যসহ প্রশাসনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করতে পারছেন। শুধু জাহাঙ্গীরনগর নয়, বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করছে শক্তিশালী এই নেক্সাস।
এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই ক্যাম্পাসগুলোকে অনিরাপদ করে তুলেছে। শক্তিশালী এই নেক্সাস না ভাঙলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে, ক্যাম্পাসের পরিবেশ নিরাপদ করা সম্ভব কি? মূল সেই কাজটি না করে আর যেসব পদক্ষেপ, তা নিছক লোকদেখানো কিংবা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।
● মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী