জলবায়ু আন্দোলনের বিরাজনীতিকরণ

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯। এই জলবায়ু পরিবর্তন একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম। নানা দেশ থেকে আসা বিশ্বনেতাদের পদচারণে মুখর তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসসমৃদ্ধ আজারবাইজান। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ আন্দোলন করে জানান দিচ্ছে তাদের সরব উপস্থিতি।

জলবায়ু আন্দোলনের প্রসঙ্গ এলেই চোখে ভেসে ওঠে ২১ বছর বয়সী টগবগে গ্রেটা থুনবার্গের নাম। ধীরে ধীরে তাঁর এই জলবায়ু আন্দোলন দেশ-বিদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। দৃষ্টি কাড়ে সবার, তেমনি জনপ্রিয়তা লাভ করে খুব দ্রুতই। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বহুজাতিক দাতা সংস্থা স্বীকৃতি দেয় এসব আন্দোলন। জলবায়ু ঝুঁকির কবলে থাকা বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশও এই আন্দোলনের ব্যতিক্রম নয়। দেখা মেলে এ দেশের বিভিন্ন সংস্থার জলবায়ু আন্দোলনের ঘটনা।

আমাদের দেশ স্বল্পোন্নত ও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে বহু মানুষ প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে। আমাদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এসব সম্মেলন, সেমিনার কতটা বাস্তবসম্মত ও কার্যকর?

ধনী দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নির্গমন আমাদের মতো দেশগুলোকে বেশি ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই সমস্যা প্রকৃতিসৃষ্ট নয়। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে আমরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছি উন্নত বিশ্বের তরফ থেকে। বিশ্ব মানচিত্রের দক্ষিণের দেশগুলো, অত্যন্ত দূষণকারী শিল্প, যেমন চামড়া, খনি, চা, তৈরি পোশাক, চিংড়ি, জাহাজ ভাঙার জন্য যেন একরকম অঘোষিত স্বর্গ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই শিল্পগুলো শুধু কার্বন নির্গমনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি বরং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ব্যাহত করছে। যার ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তাদের পূর্বপুরুষের জমি থেকে বাস্তুচ্যুত, এমনকি উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। আর এসব ঘটছে কমবেশি উন্নত দেশ এবং তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পুঁজি সঞ্চয় ও স্বার্থকে রক্ষা করতে। শিল্পায়ন ও উন্নয়নের নামে বিশ্বের নানা দেশে কৃষিজমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে সামরিক আগ্রাসনের নির্মম ও বঞ্চনা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি।

ঐতিহাসিকভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের এই ভূখণ্ডের সংগ্রামী মানুষ লড়াই করেছে শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে। প্রয়োজনে তারা সশস্ত্র হয়েছে, মৃত্যুর সঙ্গে তারা করেছে আলিঙ্গন। বর্গী থেকে শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তারা ছিল সরব। সেসবের সাহসী গল্পে এখনো আমরা প্রেরণা পাই। পরিবেশগত নানা আন্দোলনেও এ জনপদের মানুষ নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে বারবার।

এই ২০০৬ সালের আগস্টে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘিরে রক্তাক্ত হয় দিনাজপুরের জনপদ। দেশের সম্পদ রক্ষার এই আন্দোলনে সেদিন বিশাল সমাবেশে প্রাণ হারান তিন তরুণ—তরিকুল, আমিন ও সালেকিন। আহত হন দুই শতাধিক আন্দোলনকারী। আন্দোলনের মুখে এশিয়া এনার্জি এ দেশ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া ২০১৩ সালে নাটোর ও পাবনা অঞ্চলের বড়াল নদ রক্ষার জন্য ঐতিহাসিক সেই মানববন্ধনের কথা তো ভোলার নয়। যদিও সেসব আন্দোলনের অনেক অর্জন এখনো অধরা।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব জলবায়ু আন্দোলন হয়, সেগুলো কি আমরা ফুলবাড়িয়া কিংবা রামপালের মতো সংগঠিত করতে পেরেছি? শুধু কি এই আন্দোলনকে আমরা প্রেসক্লাব কিংবা নামীদামি হোটেলের কনফারেন্সের মধ্যেই আবদ্ধ রাখব? নাকি কপ কিংবা বড় কোনো সম্মেলনে লাইভে এসে প্রকাশ করব ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল থেকে আমাদের প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির গল্প?

নিঃসন্দেহে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশের নানা নীতি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই উন্নয়ন শিল্পের দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের জলবায়ু আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি ছাড়া, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো আন্দোলন তো বড়জোর হোটেলের বলরুম গরম করা বক্তব্য ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। এই না পারাতে তো কোনো দোষ দেখি না। পৃষ্ঠপোষকের বিরুদ্ধে যে তা–ও সমালোচনা করা যায়, এই–বা কম কি!

মোদ্দাকথা, আমাদের আন্দোলন এখন, রাজার পেয়াদা মানুষ মেরেছে, তাই রাজার কাছে প্রতিকার চাওয়ার অবস্থা! আর যদি রাজা করুণা করে কিছু ক্ষতিপূরণ দেন কিংবা মন ভোলানো কিছু গল্প যদি বলেন, তাহলে তো বেশ! মহারাজের জয় হোক! তাই এই আন্দোলন মহারাজের জয় কিংবা বন্যার পর কিছু রিলিফ ঠিকই দিতে পারবে কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলে তীব্র লবণাক্ততা কিংবা অসময়ে বন্যায় ভেসে যাওয়া ঠেকাতে পারবে না।

তাই এখন সময় হয়েছে জলবায়ু আন্দোলনগুলোকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক সমান্তরালে সংগঠিত করার। যেখানে সব উপনিবেশবিরোধী রাজনৈতিক জোট এবং মানুষের একটি উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার থাকবে। যেখানকার আন্দোলনের ভাষা থেকে শুরু করে স্লোগান কোনো কিছু কারও শেখানো হবে না। তা হবে আমাদের মতো। কেননা, আমরা খুব স্পষ্টতই বিস্ময় ভরা চোখে দেখেছি, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় নাক উঁচু বিভিন্ন সংস্থার নীরব ভূমিকা! তারপরও যদি আমরা তাদের ওপরই প্রকৃত জলবায়ু আন্দোলন তৈরি করার বিশ্বাসে অনড় থাকি, তবে বলতেই হয়—অন্ধ ভালোবাসা কোনো কিছুকে ভাসায় না, ডুবিয়ে দেয়।

  • ফাহিম ফয়সাল জলবায়ু অধিকারকর্মী ও গবেষণা সহযোগী, ক্যাটালাইজিং সাসটেইনেবল ট্রান্সফর্মেশন নেটওয়ার্ক।