পাকিস্তানে যে চার কারণে বাংলাদেশের মতো কিছু ঘটবে না

বেলুচিস্তানের কোয়েটায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের বিক্ষোভ। গত রোববারে।ছবি: এএফপি

বাংলাদেশের পর এবার কি তাহলে পাকিস্তান?
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তাসহ বহু বিষয় নিয়ে উদ্ভূত সংকটের পটভূমিতে পাকিস্তানে ‘বর্ষাবিপ্লব’ কি চলে এসেছে?

বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের কারণে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

তবে এখনই এসব প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে কি না, তা ভেবে দেখার অবকাশ আছে বলে মনে করি।

২০২২ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর পাকিস্তানে রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সমাজব্যবস্থার ব্যবধান উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।

কারণ, এখানে অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এবং আইনের শাসন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখানকার জনসাধারণ ক্ষুব্ধ। কারণ, তাদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে।

আরও পড়ুন

দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ পাকিস্তানে বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতির হার, তা এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ। সেখানে সোয়া কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং আরও ৯ কোটি ৫০ লাখ লোক দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে।

পাকিস্তান ইকোনমিক সার্ভে নামের একটি জরিপ প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা অনুসারে, সেখানে ৪৫ লাখ যুবক এ মুহূর্তে বেকার।

দেশটিতে বেকারত্বের হার ১১ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যে সবচেয়ে বেশি। একটু বেশি আয় করা ও একটু ভালোভাবে জীবনযাপনের আশায় গত দুই বছরে ১৬ লাখ পাকিস্তানি নাগরিক মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন।

এর বাইরে অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত অর্থনীতিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উদ্যোগ হিসেবে আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কারণে অনানুষ্ঠানিক খাতে অনেক তরুণ বেকার হবেন।

এ ছাড়া ইন্টারনেটে বিঘ্ন ঘটানোর ফলে ফ্রিল্যান্স সেক্টরেও বহু তরুণ বেকার হবেন।

অশান্ত খাইবার পাখতুনখাওয়ার পশতুন তাহাফুজ মুভমেন্টের নেতা মনজুর পশতিন এবং বেলুচিস্তানের বেলুচ ইয়াকজেহতি কমিটির মাহরং বালুচের মতো তরুণ নেতারা নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বিক্ষুব্ধ তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিচ্ছেন।

আরও পড়ুন

তাহলে পাকিস্তান কি জেনারেশন জেড বা জেন-জি বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত?
না, পুরোপুরি নয়।

বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে পাকিস্তান পরিস্থিতি কিছুটা সমান্তরাল অবস্থানে থাকলেও নিচের চারটি কারণে পাকিস্তানের বিপ্লবের সাক্ষী হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

প্রথমত, কিছু লোক যুক্তি দেখান, পাকিস্তান একটি বারুদের কৌটার মতো হয়ে আছে এবং একটি স্ফুলিঙ্গের ছোঁয়া দিলেই বাংলাদেশের মতো দেশব্যাপী প্রতিবাদ বিস্ফোরিত হবে। কিন্তু সেটি হবে না।

তার কারণ, বাংলাদেশের অভিন্ন জাতীয়তা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ক্ষোভকে একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করেছে।

কিন্তু পাকিস্তানের জাতিগত ভিন্নতা ও খণ্ডিত রাজনৈতিক দৃশ্যপট একটি দেশব্যাপী বিদ্রোহ চাগিয়ে তোলার পথে বড় অন্তরায় হয়ে আছে।

বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় চলমান বিক্ষোভ পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে কোনো প্রভাব তৈরি করেনি। অথচ শেষোক্ত এই দুই প্রদেশে পাকিস্তানের জনসংখ্যার বেশির ভাগ বাস করে।

আরও পড়ুন

পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়েছে। বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার মতো পাঞ্জাবেও গত বছরের ৯ মে দাঙ্গার পর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) রাজনৈতিক কর্মীদের জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গুম করা হয়েছে।

কিন্তু তারপরও এই বিদ্রোহ না করে তার বদলে পাঞ্জাব ও সিন্ধুর দক্ষ শ্রমিক ও পেশাজীবীরা দেশ ছেড়ে পশ্চিম ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছেন।

ফলে তাদের প্রতিবাদ-আন্দোলন বিক্ষিপ্ত থেকে যাচ্ছে। এসব বিক্ষিপ্ত আন্দোলনকে জাতীয় আন্দোলনে একীভূত করার মতো নেতৃত্ব সেখানে নেই।

বিদ্যমান আন্দোলনের এই বিক্ষিপ্ত অবস্থার পাকিস্তান সরকারকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটিকে সহজ করে দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর ধরে দেশ শাসন করেছে এবং শেখ হাসিনা টানা চারবার জয়ী হয়েছেন।

একই সময়ে পাকিস্তানে তিনটি ভিন্ন দল শাসন করেছে। গত দুই দশকে পাকিস্তানে কোনো সরকারই পরপর দুটি নির্বাচনে জয়ী হতে পারেনি।

আরও পড়ুন

অধিকন্তু, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার কার্যত একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও পাকিস্তানে ছিল ঝুলন্ত পার্লামেন্ট। সেখানে জোট সরকার শাসন করে আসছে।

২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানকে সরিয়ে দেওয়ার পর পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ হয়েছিল।

পাকিস্তান যদি কখনো কোনো বিপ্লবের কাছাকাছি এসে থাকে, তাহলে তা ছিল গত বছরের ৯ মে। কিন্তু সেই গণ-আন্দোলনকেও সামরিক বাহিনী নির্মমভাবে দমন করেছিল।

আজকের পাকিস্তানে ৯ মের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা খুবই কম।

তৃতীয়ত, শেখ হাসিনা যেমন সব বিরোধী নেতাকে কারারুদ্ধ করেছিলেন এবং লৌহ মুষ্টিতে এককভাবে বাংলাদেশকে শাসন করেছিলেন, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি।

পাকিস্তানে আজকে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে প্রধান সব রাজনৈতিক দলের ভূমিকা রয়েছে।

উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, পিটিআই বর্তমানে খাইবার পাখতুনখাওয়ায় শাসন করছে, পিপিপি সিন্ধু ও বেলুচিস্তান প্রদেশ চালাচ্ছে; আর পিএমএলএন কেন্দ্র ও পাঞ্জাবের দায়িত্বে রয়েছে।

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী যখনই শেখ হাসিনার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দেওয়া বন্ধ করেছে এবং জেন-জি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেছে, তখনই হাসিনার শাসন তাসের ঘরের মতো ধসে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সংস্থা দৃঢ়ভাবে পিএমএলএনের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

তাই এসব দলের মধ্যে জটিল রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও অমীমাংসিত নির্বাচনী বিরোধ থাকা সত্ত্বেও তারা এই বিদ্যমান ব্যবস্থাকেই নিজেদের জন্য ভালো বলে মনে করছে এবং তারা চলমান সংকট সমাধানের আইনি ও রাজনৈতিক উপায় খুঁজছে।

চতুর্থ ও সর্বশেষ কারণটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অবস্থানগত ভিন্নতা।

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী যখনই শেখ হাসিনার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন দেওয়া বন্ধ করেছে এবং জেন-জি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেছে, তখনই হাসিনার শাসন তাসের ঘরের মতো ধসে গেছে।

কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সংস্থা দৃঢ়ভাবে পিএমএলএনের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানির বক্তব্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো ‘একটি বেসামরিক মুখোশ পরা সামরিক শাসন’।

সুতরাং, বর্তমান সংকটের সঙ্গে সামরিক বাহিনী গভীরভাবে জড়িয়ে আছে।

এ কারণে ধারণা করছি, বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানে গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে হলে জেন-জি বিক্ষোভকারীদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

  • দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে নেওয়া
    অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
    আবদুল বাসিত সিঙ্গাপুরের এস রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একজন সিনিয়র সহযোগী ফেলো।