দেশে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী গত ১৪ আগস্ট বিদ্যুৎ ভবনে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স আয়োজিত বাংলাদেশের জ্বালানিনিরাপত্তা শীর্ষক সেমিনারে দেশের গ্যাসসম্পদের ওপর আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেছেন যে দেশের ভূতত্ত্ববিদেরা কেউ বলেন দেশে আরও গ্যাস আছে, কেউ বলেন গ্যাস নেই; তাই দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়! তিনি আরও বলেন, গ্যাস উত্তোলনে অনেক কূপ খনন করা হয়েছে, তবে কিছুই পাওয়া যায়নি (ডেইলি স্টার, অনলাইন রিপোর্ট ১৪ আগস্ট ২০২২)। তাঁর উপরিউক্ত দুটি বক্তব্যই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারি উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের মন্তব্য বা বক্তব্য আমরা একনিষ্ঠভাবে শুনি ও বোঝার চেষ্টা করে থাকি। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একজন সুবক্তা, বুদ্ধিমান ও দক্ষ প্রশাসক। কিন্তু তাঁর উপরিউক্ত বক্তব্য দেশ-বিদেশের ভূবিজ্ঞানীদের অবাক করেছে।
সমাবেশে দেওয়া তাঁর প্রথম বক্তব্যটি অর্থাৎ ‘কেউ বলে গ্যাস আছে, কেউ বলে নেই’ একটি কথার কথা হতে পারে, তবে দেশে এখনো অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে একজন বা দুজন ভূবিজ্ঞানীর ব্যক্তি সূত্রকে আলোচনায় না এনে বরং এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার নিয়োজিত একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক সম্পাদিত মূল্যায়নের বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন বিবেচনায় আনাই কি যৌক্তিক নয়?
উপরিউক্ত সব প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে একমত প্রকাশ করা হয় যে বাংলাদেশে এখনো অনেক গ্যাসসম্পদ অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে তা উত্তোলন করে কাজে লাগানো যেতে পারে।
বাংলাদেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বাংলাদেশে গ্যাস সাফল্যের হার ১: ৩ অর্থাৎ তিনটি অনুসন্ধান কূপ খননে একটি গ্যাস সাফল্য, যেখানে বিশ্বব্যাপী গড় সাফল্যের হার ১: ৫। এখানে উল্লেখযোগ্য যে একটি দেশের গ্যাস-তেল অনুসন্ধানের মাত্রা মূল্যায়িত হয় সে দেশে প্রতিবছর অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা বিবেচনার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাস বা তেলক্ষেত্রে খনন করা উন্নয়ন কূপ বা মূল্যায়ন কূপ বিবেচনায় আনা হয়নি।
বাংলাদেশে ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ (ইউএসজিএস) ও পেট্রোবাংলা যৌথভাবে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের সম্ভাবনার যে মূল্যায়ন করে, তাতে দেখানো হয় যে এ দেশে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের গড় পরিমাণ ৩২ টিসিএফ। এর মধ্যে ২৩ টিসিএফ গ্যাস ভূখণ্ডে এবং ৯ টিসিএফ গ্যাস অগভীর সাগরবক্ষে (পানির গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত)। এ জরিপে দেশের গভীর সমুদ্র অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি যেহেতু সে সময় বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র অঞ্চলের তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ছিল।
উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার করে। ইউএসজিএস যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৈজ্ঞানিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যেটি সে দেশের নিজস্ব এলাকায় এবং বহির্বিশ্বের বহু স্থানে অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদ মূল্যায়নের কাজ করে থাকে। এ মূল্যায়ন করার জন্য ইউএসজিএস যে পদ্ধতিটি ব্যবহার করে, তা বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। উপরিউক্ত জরিপটি সম্পন্ন করার জন্য এর আগে দেশি-বিদেশি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সংগৃহীত ও পেট্রোবাংলা কর্তৃক প্রদত্ত সব ভূতাত্ত্বিক ও ভূপদার্থিক তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়।
২০০১ সালে নরওয়ে সরকারের নরওয়েজীয় পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টরেট ও বাংলাদেশের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি অঙ্গ সংস্থা যৌথভাবে এ দেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের ওপর অন্য একটি জরিপ চালায়। এ জরিপে কাজের জন্য এর আগে পেট্রোবাংলা ও বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক সংগৃহীত সব তথ্য-উপাত্ত (ভূতাত্ত্বিক ভূপদার্থিক ও আনুষঙ্গিক) জোগাড় করা হয়। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে যে রিপোর্টটি পেশ করা হয়, তাতে দেখানো হয় যে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৪২ টিসিএফ। এ জরিপে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক উপাদানসমূহকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা হয় এবং সমগ্র এলাকায় মোট ছয়টি পেট্রোলিয়াম সিস্টেম শনাক্ত করা হয় এবং সেসব আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয়। এ জরিপেও দেশের গভীর সমুদ্র অঞ্চলকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়নি, যেহেতু সেখানের তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়।
২০১১ সালে অপর একটি আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস পরামর্শক গুসতাফসন অ্যাসোসিয়েট আরেকটি মূল্যায়ন সম্পন্ন করে এবং সেখানে দেখানো হয় যে ৫০ শতাংশ সম্ভাবনায় বাংলাদেশ অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের গড় পরিমাণ ৫৪ টিসিএফ। এই মূল্যায়নে দেখানো হয় যে ৯০ শতাংশ সম্ভাবনায় এর পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। ২০১৮ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সরকারের গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান রিপোর্টে দেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসসম্পদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গুসতাফসন অ্যাসোসিয়েটের (২০১১) কাজটি সবচেয়ে মূল্যবান বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং এই মন্তব্য করা হয় যে এই মূল্যায়নের আলোকে বাংলাদেশের সব এলাকায় পর্যাপ্ত গ্যাস অনুসন্ধান করা হলে বাংলাদেশের গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ বর্তমান মাত্রার দ্বিগুণ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে (বাংলাদেশ গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান ২০১৮)।
প্রতিমন্ত্রীর দ্বিতীয় বক্তব্য যে ‘অনেক কূপ খনন করা হয়েছে কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি’, তা ঠিক কোন তথ্যসূত্র থেকে বলা হয়েছে, তার উল্লেখ নেই। তবে দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের সব তথ্য থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে এ দেশে অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা নেহাতই অল্প।
বিশ্বের অন্যান্য গ্যাস ধারণ করা বেসিনের তুলনায় বাংলাদেশ সর্বনিম্ন অনুসন্ধান করা এলাকা বলে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিত। একটি উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের একটি প্রদেশ ত্রিপুরা, যার আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং সেখানে আজ অবধি অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা ১৬০টি। আর বাংলাদেশের আয়তন ১৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এখানে আজ অবধি অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা ৯৯। বাংলাদেশে গত ২২ বছরে অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা ২৬ (সূত্র: বাপেক্স, পেট্রোবাংলা ২০২২) অর্থাৎ বছরে গড়ে ১ দশমিক ২টি কূপ।
তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে যেকোনো মানদণ্ডে এটি খুবই অল্প মাত্রার অনুসন্ধান। এত অল্প অনুসন্ধান কূপ খননে এতটা উল্লেখযোগ্য গ্যাস মজুত পাওয়া গেছে, যেটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং তা নিশ্চয়ই এই এলাকায় আরও যথেষ্ট অনুসন্ধান কূপ খননের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরে।
বাংলাদেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বাংলাদেশে গ্যাস সাফল্যের হার ১: ৩ অর্থাৎ তিনটি অনুসন্ধান কূপ খননে একটি গ্যাস সাফল্য, যেখানে বিশ্বব্যাপী গড় সাফল্যের হার ১: ৫। এখানে উল্লেখযোগ্য যে একটি দেশের গ্যাস-তেল অনুসন্ধানের মাত্রা মূল্যায়িত হয় সে দেশে প্রতিবছর অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা বিবেচনার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাস বা তেলক্ষেত্রে খনন করা উন্নয়ন কূপ বা মূল্যায়ন কূপ বিবেচনায় আনা হয়নি।
তৃতীয় একটি বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে বাপেক্স। ১৯৯৮ সালে বাপেক্স আবিষ্কৃত ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে একটি কূপ খনন শুরু হয়েছে, যেটির নামকরণ করা হয়েছে টবগী-১ কূপ। কূপটির অবস্থান শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর ভেতরেই এবং সে অনুযায়ী তা একটি উন্নয়ন কূপ।
এ অবস্থায় কূপটি অনুসন্ধান কূপ বলে ঘোষণা দেওয়া মানে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যকলাপের মৌলিক সংজ্ঞাকে লঙ্ঘন করা। বাপেক্স সম্ভবত ওপরের প্রশাসনিক মহলের আদেশে এটি করেছে। একটি জানা গ্যাসক্ষেত্রে খনন করা কূপকে কোনো সূত্রেই অনুসন্ধান কূপ বলা যায় না।
অন্য একটি বিষয় হলো, বাপেক্স জানে সে নিজেই কূপটি খননে সক্ষম। তার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিজের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রটিতে বিদেশি কোম্পানি গাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খনন করাতে বাধ্য করা হয়েছে। আর এটিও ওপরের প্রশাসনিক মহলের নির্দেশ বলে মনে করা হয়।
তা না হলে বাপেক্স যে কূপটি ৮০ কোটি টাকায় খনন করতে পারে, তা গাজপ্রমকে ১৯০ কোটি টাকা দিয়ে করাবে কেন? বাপেক্স প্রশাসনে সম্ভবত এমন কেউ নেই, যিনি ওপরতলায় গিয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই বিষয় নিয়ে আপত্তি করবেন বা বিতর্ক জুড়ে দেবেন। এই একই কারণে বাপেক্স প্রশাসন টবগী-১ কূপটি উন্নয়ন কূপ জেনেও অনুসন্ধান কূপ হিসেবে ঘোষণা করে।
একটি সক্ষম জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে তার নিজস্ব স্বকীয়তায় বেড়ে উঠতে না দেওয়া কেবল দুর্বল বা দুষ্টু পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। আর বাপেক্সের এগিয়ে যাওয়ার পথে এটিই সবচেয়ে বড় বাধা।
ড. বদরূল ইমাম অনারারি অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়