৩ আগস্ট ২০২৩-এ সিএনএনে ‘মোর বেবি বুম্বারস আর লিভিং অ্যালোন, ওয়ান রিজন হোয়াই: গ্রে ডিভোর্স’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের বিবাহবিচ্ছেদ, যা গ্রে ডিভোর্স নামে পরিচিত, আগের তুলনায় বেড়েছে ৩ গুণ, ফলে বাড়ছে নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা। ২০২২ সালে প্রায় ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী আমেরিকান নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ মিলিয়ন, যা আগের তুলনায় তিন গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা এবং বিবাহ সম্পর্কে নতুন চিন্তা এই বিচ্ছেদের মূল কারণ (সূত্র: সিএনএন, ৩ আগস্ট ২০২৩)। স্বয়ং মার্কিনরা নিঃসঙ্গ বয়স্ক মানুষের হার বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে গত ৩ জুন ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে, আবেদনকারীদের ৭০ শতাংশ নারী। বিবাহবিচ্ছেদের এই হার জনমনে তৈরি করেছে উদ্বেগ। আমাদের দেশে গ্রে ডিভোর্সের হার কম হলেও অনেক ক্ষেত্রেই অনেক তারকা দম্পতি কিংবা সুপরিচিত ব্যক্তির বিবাহবিচ্ছেদের খবর পত্রিকার পাতায় জায়গা পায়; অলক্ষ্যে রয়ে যায় নাম না জানা অনেক দম্পতির দীর্ঘদিনের বৈবাহিক সম্পর্কের বিচ্ছেদের গল্প।
একসময় নারী তাঁর মৌলিক চাহিদা ও নিরাপত্তার জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এখন প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর জয়জয়কার। অনলাইন বিজনেসের একটা বড় অংশ নারীদের দখলে। আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে নিজের মর্যাদা ও সম্মানের বিষয়ে আজকের নারী আপসহীন। নারীর এই বোধ তাঁকে পুরুষশাসিত শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে স্বাধীন জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করছে।
অন্যদিকে বাঙালি পুরুষেরা এখনো নারীর ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। প্রতিদিনের আহার প্রস্তুত, কিংবা শেষ জীবনে অসুস্থ হয়ে শয্যায় পড়ে থাকা একজন পুরুষের জন্য স্ত্রীই ভরসা। ফলে বিবাহিত জীবনের প্রথম দিকে অনেক স্ত্রী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের নিয়ন্ত্রণ স্ত্রীর হাতে চলে আসে। জীবনে আমি অনেক স্ত্রীকে দেখেছি, অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী স্বামীর সেবা করতে করতে স্বামীর আগে নিজের জীবনের যবনিকা টেনেছেন।
যে নারী বাইরে কাজ করছেন না, তাঁর জন্য একা হাতে সংসার সামলানো সুখকর হতে পারে, কিন্তু একজন কর্মজীবী নারীর জন্য মাঝেমধ্যেই দুই দিক সামাল দেওয়া যেন হয়ে ওঠে অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক চাপ। অনেক পরিবারে নারীর অগ্রযাত্রাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে এটা যেমন সত্যি, সেই সঙ্গে নারীর জন্য কিছু বেঁধে দেওয়া ফ্রেমও তৈরি করা আছে। একদিকে সংসারের দায়িত্ব ও সন্তান লালন-পালন; অন্যদিকে চাকরি কিংবা ব্যবসা করে অর্থ রোজগার—উভয় কাজের চাপ নারীর জন্য যেন বোঝাস্বরূপ।
অসুখী বৈবাহিক জীবনও অনেকের জীবনে সিসিফাসের শাস্তির মতো এক অসহনীয় প্রস্তরখণ্ড পর্বতের চূড়া পর্যন্ত বয়ে নেওয়ার মতো, নিজের অনিচ্ছায় মেনে চলা এক দুর্বিষহ এবং অর্থহীন রুটিন। অন্যদিকে সুখী দাম্পত্য জীবন মানে হলো, যত্ন আর মায়ায় তৈরি এক ভালোবাসার প্রাসাদ, যার নির্মাণ স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুতেই কেবল শেষ হতে পারে। আপনি প্রতিদিন ভালোবাসার প্রাসাদ নির্মাণ করবেন, নাকি অসহনীয় প্রস্তরখণ্ড বয়ে বেড়াবেন? জীবন যাঁর, সিদ্ধান্ত তাঁর।
ফলে স্বামী-স্ত্রীর জ্ঞানের পরিধি, চিন্তার প্রসারতা কিংবা জীবনের লক্ষ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে মতের অমিল হলেও স্ত্রীর ওপর স্বামীর নির্ভরশীলতা, সামাজিক মর্যাদাহানি হওয়ার ভয়, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের চাপ ইত্যাদি কারণে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা দীর্ঘশ্বাস ও হতাশা নিয়ে অসুখী জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। একই ছাদের নিচে বসবাস করেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব যেন লাখ কোটি মাইল। লোকদেখানো বৈবাহিক সম্পর্ক দৃশ্যমান হলেও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণ একেবারে নিষ্ক্রিয় ও অদৃশ্য। অনেকে জড়িয়ে পড়েন বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে। অনেক স্বামী-স্ত্রী নিজের জীবনের সব চাহিদা ও স্বাচ্ছন্দ্য ভুলে ধীরে ধীরে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
বিশ্বায়নের এই যুগে খুব সহজেই ধারণা করা যায়, সম্পর্কের ভিত মজবুত না হলে লোকদেখানো সম্পর্ক খুব বেশি দিন টিকিয়ে রাখা মুশকিল। ফলে নারীর ওপর সংসার ও সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বের চাপ কমাতে না পারলে বর্তমানে ঢাকা শহরে ৪০ মিনিটে ১টি বিচ্ছেদের যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, তা ১০-১৫ বছর পর হয়তো আরও বাড়বে। অনুমান করা যায়, বাড়বে পঞ্চাশোর্ধ্ব নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যাও।
সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজ হলো নিজের জন্য উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচন করা। কারণ, সঙ্গী নির্বাচন যেন এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর নির্বাচনের মতো আমরা নিজের পছন্দমতো কাস্টমাইজ করে সঙ্গী তৈরি করতে পারি না; বরং সীমিত অপশনের মধ্য থেকে নির্বাচন করি। তাই সঙ্গী নির্বাচন ভুল হওয়ার ফল শূন্য, মাঝেমধ্যে নেগেটিভ মার্কিংয়ের মতো নিজের সুখ-শান্তি যা ছিল, সেগুলোও হারাতে হয়। তাই পরিবারের চাহিদা নয়; বরং নিজের পছন্দ ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে, এমন সঙ্গী নির্বাচন করা উচিত।
বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে নিজের পছন্দ-অপছন্দ এবং সঙ্গীর কাছে প্রত্যাশা সততার সঙ্গে শেয়ার করা উচিত। নিজের স্বভাব কিংবা পারিবারিক কোনো দুর্বলতা থাকলে সেগুলো অকপটে সম্পর্ক তৈরির আগেই জানিয়ে দেওয়া জরুরি। তথ্য গোপন অনেক সময় প্রতারণার শামিল। যে সম্পর্ক প্রতারণা দিয়ে শুরু হয়, সেই সম্পর্কের ভিত্তি কখনোই মজবুত হতে পারে না।
আমার কাছে মনে হয়, সম্পর্ক হলো এক টুকরা কাপড়ের মতো, যা যত্নে ভালো থাকে, অযত্নে নষ্ট হয়ে যায়। কাপড়ের বুনন যত মিহি ও নিখুঁত হবে, তা তত বেশি নরম, আরামদায়ক আর সুন্দর হবে। সম্পর্কগুলোও তেমন—আদর, যত্ন আর ভালোবাসার সুতা দিয়ে যতটা সম্ভব মিহি ও নিখুঁত করে তৈরি করতে হয়। প্রতিদিন তাতে যত্নের পরশ দিতে হয়। অযত্নে ফেলে রাখলে তা হয় চুরি হয়ে যাবে, নয়তো তার রং ও সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সম্পর্কের সুতা ছিঁড়ে যাওয়ার আগেই তাতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে হবে। কাপড়ের দাগ তুলতে গিয়ে তাতে বেশি জোর-জবরদস্তি করলে পুরো কাপড়টাই ছিঁড়ে পরিধানের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তেমনি সম্পর্কে কোনো সমস্যা বা মনোমালিন্য হলে সঙ্গীর সঙ্গে অতিমাত্রায় জোর-জবরদস্তি না করে তাকে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য সময় দেওয়া জরুরি।
অনেক দম্পতি নিজেদের মধ্যকার চরম মানসিক দ্বন্দ্ব আছে জেনেও বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে দ্রুত সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন। এতে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্ক টেকে ঠিকই, স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি কোনো মায়া বা সম্মোহন কাজ করে না। ফলে একদিকে দম্পতি নিজেদের যেমন অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন, তেমনি সন্তান বঞ্চিত হয় তার বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ থেকে।
মা-বাবার মধ্যকার তিক্ত সম্পর্ক সন্তানের সুস্থ ও সুন্দর মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। তাই সন্তান গ্রহণের আগে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন জরুরি। সমাজের কথা ভেবে দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার চেয়ে দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, মানুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সুখী জীবনের আশায়, সারা জীবন একই ছাদের নিচে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা শত্রুর সঙ্গে বসবাস করার জন্য নয়।
উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া জীবনযাপন, সঙ্গীর প্রতি অতিরিক্ত প্রত্যাশা ও চাহিদা যেমন সঙ্গীর অধিকারকে খর্ব করে; তেমনি সঙ্গীর প্রতি অতিরিক্ত বদান্যতা বা আনুগত্য মানে হলো নিজের স্বাধীনতা ও অধিকারকে সঙ্গীর ইচ্ছার কাছে বলিদান। উভয়ই সুসম্পর্কের অন্তরায়। তাই সুখী দাম্পত্য জীবন মানে হলো মধ্যপন্থা অবলম্বন করে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। সংসারজীবন একটি বাঁশের সাঁকো, যেখানে প্রতি মুহূর্তে ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। নিজের স্বার্থে সঙ্গীকে ব্যবহার করে তাঁর ব্যক্তিক ও নাগরিক অধিকার খর্ব করা হলে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্ক তাঁর জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। একসময় তা সমাপ্ত হয় বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে।
সুতরাং দাম্পত্য জীবনের পথ মসৃণ ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে সঙ্গীর অধিকার ও সম্মান রক্ষা করা উচিত। ভালো কাজের স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা, সেই সঙ্গে তাঁর নিজস্ব স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গায় হস্তক্ষেপ না করা নৈতিক মানুষমাত্রেই কর্তব্য। সঙ্গীর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ও অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ—উভয়ই মানুষের স্বাভাবিক চলার গতিতে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা দুজন মানুষের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান সুখী দাম্পত্য জীবনের মূল চাবিকাঠি।
সুখী সংসার মানে একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা নয়; বরং একে অপরের সহযোগী হয়ে পাশাপাশি পথচলা। সংসারসাগর সহজ ও সুন্দরভাবে পাড়ি দেওয়ার জন্য স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সাঁতার জানাটা জরুরি। একটি রেললাইনের দুটি পাত যেমন কেউ কারও ওপর নিয়ন্ত্রণ না করে সমান্তরালে চলে, স্বামী-স্ত্রী তেমনি কেউ কারও নিয়ন্ত্রক নন; বরং পরস্পরের সহযোগী, একে অপরের ওপর হস্তক্ষেপ না করে নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য করে সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়া যাঁদের কাজ। রেললাইনের পাতকে চাকার ঘর্ষণে উৎপন্ন তাপে বেঁকে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর পাতের মধ্যে ফাঁকা রাখা হয়। একইভাবে সংসারের চাপে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য উভয়ের জন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও বিনোদন আবশ্যক; অর্থাৎ পারস্পরিক সমঝোতা, কৃতজ্ঞতা ও সম্মান দীর্ঘস্থায়ী সুখী দাম্পত্য জীবনের পূর্বশর্ত।
শেষ করছি আলবেয়ার কাম্যুর দ্যা মিথ অফ সিসিফাস বইয়ের সিসিফাসের কাহিনি উল্লেখ করে। গ্রিক পুরানের অভিশপ্ত চরিত্র সিসিফাসকে শাস্তি হিসেবে দেবতার আদেশে একটি অতিকায় প্রস্তরখণ্ড পর্বতের চূড়ায় তুলতে হয়। সিসিফাস প্রস্তরখণ্ড পর্বতের চূড়ায় তোলার সঙ্গে সঙ্গে তা গড়িয়ে নিচে নেমে আসে, সিসিফাসকে আবার তা পর্বতের চূড়ায় তুলতে হয়। এভাবে সিসিফাস একই কাজ বারবার করতে থাকে। এর কোনো শেষ নেই।
অসুখী বৈবাহিক জীবনও অনেকের জীবনে সিসিফাসের শাস্তির মতো এক অসহনীয় প্রস্তরখণ্ড পর্বতের চূড়া পর্যন্ত বয়ে নেওয়ার মতো, নিজের অনিচ্ছায় মেনে চলা এক দুর্বিষহ এবং অর্থহীন রুটিন। অন্যদিকে সুখী দাম্পত্য জীবন মানে হলো, যত্ন আর মায়ায় তৈরি এক ভালোবাসার প্রাসাদ, যার নির্মাণ স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুতেই কেবল শেষ হতে পারে। আপনি প্রতিদিন ভালোবাসার প্রাসাদ নির্মাণ করবেন, নাকি অসহনীয় প্রস্তরখণ্ড বয়ে বেড়াবেন? জীবন যাঁর, সিদ্ধান্ত তাঁর।
নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা
ই-মেইল: [email protected]