ইতিহাস বিস্ময় পছন্দ করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ যুগে মানবজাতি হয়তো অনেক কিছুই আগে থেকে ধারণা করতে পারে। কিন্তু পৃথিবী তো ঘোরে তার মতো। ঘটে অপ্রত্যাশিত নানা ঘটনা। পূর্বাভাস বদলে গিয়ে হতাশাজনক নানা ঘটনা ঘটে। ভয়ংকর ক্ষতির মুখে পড়ে মানুষ।
আর অল্প কিছুদিন বাদেই হয়তো ২০২৩ সালকে মানুষ ভুল ভাষ্যে ভরপুর বছর হিসেবে চিহ্নিত করবে, যে বছরে পূর্বাভাসগুলো সে অর্থে কাজে আসেনি।
আমরা অনেক পূর্বাভাস পেয়েছিলাম। মূল্যস্ফীতি সাময়িক হবে, ইউক্রেন জিতে যাবে, নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়া ভেঙে পড়বে, মস্কো থেকে জ্বালানি সরবরাহ স্থগিত রাখলেও ইউরোপের শিল্পোৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়বে না, চীনের অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে আসবে, একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র টিকে থাকবে, আব্রাহাম অ্যাকর্ড এবং ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে, যুক্তরাষ্ট্র যে ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার কথা বলে বিশ্বজুড়ে কেবল তা–ই প্রযোজ্য হবে—এই তালিকা আরও বাড়ানো যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর নজর যেন তাদের দিকেই থাকে, ইউক্রেন এখন সেই বেপরোয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষমতা তারা বহুলাংশে হারিয়ে ফেলেছে।
অন্যদিকে ইসরায়েল চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলো যেন তাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। এই ফাঁকে তারা গাজায় জাতিগত নিধনের কাজটা সেরে ফেলতে চায়। তাদের দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকেরা যে বৃহৎ ইসরায়েলের স্বপ্ন দেখছেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম ধাপের বাস্তবায়ন হবে এতে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন রাশিয়া–ইউক্রেন ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ২০২৪ সালে এ দ্বন্দ্ব কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধের ভবিষ্যৎ ইউরেশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে। ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়রা একদিকে এবং রাশিয়া, চীন ও ইরান অন্যদিকে। এই দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ এখন চরমে।
ভাঙা স্বপ্নের গোরস্থান
গত সেপ্টেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো চীনের উদীয়মান শক্তির গতি রোধ করতে তার পরিকল্পনা প্রকাশ করে।
ভারতীয় রাষ্ট্রপতি নরেন্দ্র মোদি, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির মতো প্রধান ও বৃহৎ অর্থনীতির ইউরোপীয় দেশগুলো এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পাশে ছিল। ওই সম্মেলনে তারা ভারতকে ইউরোপের সঙ্গে সংযোগকারী একটি করিডর উদ্বোধনের কথা বলে।
তারা এটাকে বলছে আইএমইসি—ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট–ইউরোপ করিডোর।
এ করিডরের আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য ইউরোপ থেকে ভারতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সময় কমিয়ে আনা। যে দেশগুলো এ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিল, তারা বলেছিল, পণ্যবাহী কার্গোগুলো ভারত থেকে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাবে, সেখান থেকে ট্রেনে করে ইসরায়েলের হাইফা ও হাইফা থেকে ইউরোপে পৌঁছাবে।
পাঁচ বা ছয়টি আলাদা দেশে পণ্য ওঠানামার পর গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা।
ইসরায়েল ছাড়া সব কটি দেশই বলছে, তারা লোহিত সাগরকে ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর বাড়াতে চায় না। কিন্তু গাজা ও ইউক্রেনের বাইরেও লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও লোহিত সাগরে বিরোধ ছড়িয়েছে। ফলে হিসাব–নিকাশে ভুলের ঝুঁকি ও এ অঞ্চলকে ঘিরে উত্তেজনা বাড়ার শঙ্কা এখনো অনেক বেশি।
এই পরিকল্পনার অনানুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য হলো ২০১৩ সালে গৃহীত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিকল্প খোঁজা। বিআরআইয়ের মাধ্যমে ইউরেশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার কথা।
১০ বছর পর আইএমইসির যাত্রা হলেও জোটটি এমন ভাব করছে, যেন তারা বিআরআইকে টেক্কা দেবে। এর আগেও পশ্চিমারা এমন প্রকল্প নিয়েছিল। আপনাদের নিশ্চয়ই বিল্ড ব্যাক বেটারের কথা মনে আছে। আইএমইসিও সময়ের বিবেচনায় খুবই ছোট উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। হয়তো তার জায়গা হবে ভাঙা স্বপ্নের গোরস্থানে। আদতে সময় ও বাজার বলে দেবে এই জটিল বিকল্প আদৌ কোনো কাজে আসবে কি না।
দেশগুলো আইএমইসির মাধ্যমে লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালকে প্রধান অর্থনৈতিক করিডরের জায়গা থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। এটাই ছিল আদতে তাদের প্রধান অভীষ্ট। আব্রাহাম অ্যাকর্ডসেও এ উদ্দেশ্যের উল্লেখ আছে।
কিন্তু এর মধ্যেই ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে লোহিত সাগর আলোচনায় উঠে আসে।
আঞ্চলিক অস্থিরতা
গাজার চলমান বিরোধ নিয়ে মূল যে শঙ্কা, তা হলো এই বিরোধ পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বেশির ভাগেরই দৃষ্টি এখন ইসরায়েলের উত্তর অংশে, যেখানে লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের দ্বিতীয় আরেকটি মুখ খুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের দরিদ্রতম ও সবচেয়ে কম অস্ত্রশস্ত্রের মালিক অঞ্চলটি বছরের শেষের দিকে চমক দিয়েছে ইয়েমেনের হুতিদের মাধ্যমে।
আরব বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র হুতিরাই ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের পূর্ণাঙ্গ সংহতি প্রকাশ ঘটিয়েছে। ইসরায়েলমুখী বা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এমন যেকোনো জাহাজে তারা আক্রমণ চালাচ্ছে। এতে ইসরায়েলের এইলাট বন্দরের কার্যকারিতা ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
হুতিরা পশ্চিমা গণতন্ত্রের যে দ্বিচারিতা, তার বিপরীতে নিজেদের একটি ভাষ্য দাঁড় করিয়েছে। রাশিয়া, চীন বা ইরানসহ বিশ্বের যেকোনো দেশে নিবন্ধিত জাহাজকে তারা বাব এল–মান্দেব ও লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজে ঢুকতে দিচ্ছে বিনা বাধায়।
বেশির ভাগ জাহাজই এখন লোহিত সাগর এড়িয়ে চলছে। তাদের হাতে এখন দুটি বিকল্প—হয় তাদের আফ্রিকার দক্ষিণ অঞ্চল অথবা ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর (আইএনএসটিসি) রুট নিতে হবে। এই রুট ককেশাসের মধ্য দিয়ে ইরান ও রাশিয়াকে যুক্ত করেছে।
প্রথম বিকল্পটি গ্রহণ করার উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী আবারও মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি। দ্বিতীয় বিকল্প নিয়ে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর ঘোরতর আপত্তি আছে।
যুক্তরাষ্ট্র হুতি বিদ্রোহীদের এ হামলার জবাবে ‘প্রসপারিটি গার্ডিয়ান’ নামের নতুন একটি সামরিক অভিযান শুরু করেছে। তারা বলছে, লোহিত সাগর, গালফ অব এডেন এবং বাব এল–মান্দেব প্রণালিতে স্বাধীনভাবে জাহাজ চলাচল নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ।
কঠিন বাস্তবতা
যদি প্রসপারিটি গার্ডিয়ানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে তাদের জন্য হতাশাজনক কিছু খবর আছে।
এ কথা সত্যি যে মেয়ার্সের মতো কিছু পণ্য পরিবহনকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আবারও লোহিত সাগরে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর হুতিদের হামলায় তারা লোহিত সাগরে পণ্য পরিবহন স্থগিত করে। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র হুতিদের নৌকায় হামলা চালিয়ে ১০ ইয়েমেনি যোদ্ধাকে হত্যা করে।
হতাশাব্যঞ্জক আরও যে খবর আছে, তা হলো প্রসপারিটি গার্ডিয়ানের পক্ষগুলো পেন্টাগনের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোনো অভিযানে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, ইতালি ও ফ্রান্স। স্পেন পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে, তারা শুধু ন্যাটো বা ইউরোপীয়দের নেতৃত্বেই অভিযানে অংশ নিতে পারে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে ছোট্ট দেশ বাহরাইন ও বৈশ্বিক উত্তর-দক্ষিণের বাইরে সেইশেল আছে এ জোটে।
লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় গুরুতর ক্ষতিতে পড়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও সৌদি আরবের মিত্র অন্তত দুটি দেশ এ জোটে নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও দেশটির ওপর নির্ভরতা যে তার ঘনিষ্ঠ মিত্রদের কাছেও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তার প্রমাণ এ অভিযান।
ইসরায়েল ছাড়া সব কটি দেশই বলছে, তারা লোহিত সাগরকে ঘিরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর বাড়াতে চায় না। কিন্তু গাজা ও ইউক্রেনের বাইরেও লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও লোহিত সাগরে বিরোধ ছড়িয়েছে। ফলে হিসাব–নিকাশে ভুলের ঝুঁকি ও এ অঞ্চলকে ঘিরে উত্তেজনা বাড়ার শঙ্কা এখনো অনেক বেশি।
ফলে ২০২৪ সালেও আঁধার কাটছে, এমনটা বলা যাচ্ছে না।
যদি ২০২৩ ভুলে ভরা ভাষ্য আর পূরণ না হওয়া প্রত্যাশার বছর হয়, তাহলে ২০২৪ হবে নতুন বাস্তবতায় চমকে ওঠার বছর।
মার্কো কার্নেলস ইতালীয় রাষ্ট্রদূত। তিনি সোমালিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি ও জাতিসংঘে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিরিয়ায় মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় ইতালির বিশেষ দূত ছিলেন।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত