কোভিডক্রান্তি কাটিয়ে ওঠার আগেই ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ, বৈদেশিক মুদ্রার কমতি এবং সর্বোপরি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকি থেকে চাপে এবং চাপ থেকে সংকটে নিপতিত করার শঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণে চাহিদা ও জোগানব্যবস্থায় ব্যাপক ধসের কারণে অর্থনীতি মন্দাবস্থায় পতিত হয়। এখনো সরবরাহব্যবস্থা পুরো মাত্রায় সচল হয়নি। এদিকে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েই চলেছে।
ইউক্রেন আক্রমণের ছয় মাস আগেই বাংলাদেশে রিজার্ভের ক্ষয় শুরু। বৈদেশিক মুদ্রার আয় কম হওয়ায় রিজার্ভ কমছে। গত বছরের জানুয়ারির ৪ হাজার ৫২৬ কোটি ডলার থেকে কমে এখন ৩ হাজার ৪০১ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা ৮০০ কোটি ডলার বাদ দিলে নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
২.
নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের পরিবার কঠোর আঘাতে নিষ্পেষিত। মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছ। কোভিড-১৯ শ্রমিক এবং বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের উল্লেখযোগ্য মজুরি হ্রাস করে জীবনযাত্রার ব্যয় সংকটে নিপতিত করে। বাংলাদেশে মজুরি বৃদ্ধি গত অর্থবছরে সাত বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ায় অধিকাংশ মানুষ তাঁদের সামান্য আমানত খরচ করছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দৈনন্দিন জীবন নির্বাহের জন্য ধার করছেন। একসময় তাঁরা ঋণ গ্রহণের ক্ষমতাও হারাতে পারেন।
তাঁদের দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দেবে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থনীতি আবার চালু হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ‘নতুন দরিদ্র’-এর সংখ্যা কমেনি। চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য কিনতে পারছেন না। অনেক পরিবার খাবারের পরিমাণ ও পুষ্টির মাত্রা কমিয়েছে। এ ছাড়া দাম বাড়ার ধাক্কা সামলাতে তারা কম ও নিম্নমানের পণ্য কিনছেন। খাদ্যবহির্ভূত খরচ তথা চিকিৎসা ও শিশুদের শিক্ষা ব্যয় হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছেন। কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আগামী বছর কৃষি উৎপাদন কমার আশঙ্কা রয়েছে।
সরকারের পরিসংখ্যান সংস্থা জানাচ্ছে, দারিদ্র্যের হার প্রাক্-কোভিড স্তরের ২০ শতাংশের তুলনায় প্রকৃতপক্ষে বেড়ে ২৯ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দারিদ্র্যের এই বৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্তের ক্রমহ্রাসমানতা অর্থনৈতিক হতাশার দৃশ্যমান খণ্ডচিত্র মাত্র। প্রকৃত উদ্বেগের বিষয় হলো স্বল্প মেয়াদে সংকট ব্যবস্থাপনা ও মধ্য মেয়াদে পুনরুদ্ধার ব্যবস্থাপনার অগ্রগতির অভাব।
অন্যথায় অর্থনীতি চরম বৈষম্যমূলক পুনরুদ্ধারের পথে যাবে। পুনরুদ্ধার গতিপথ ক্রমেই ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের চেহারা ধারণ করে অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হবে এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়বে। এই প্রক্রিয়ায় সমাজে বিভেদ, বৈষম্য এবং মেরুকরণ ত্বরান্বিত হবে। এ পরিবর্তন রোধ নির্ভর করবে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ওপর।
৩.
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য ও ডলারের অবমূল্যায়ন ব্যবসায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমদানি-রপ্তানিতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
অন্যদিকে নামে-বেনামে দেওয়া ঋণ আদায় হচ্ছে না। অনেক ব্যাংক তারল্যঘাটতিতে পড়ছে। ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি প্রায় অর্ধেক নেমেছে। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমানত কমেছে ১৮ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২২ সালের জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আগের প্রান্তিকে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল। এভাবে চলতে থাকলে ব্যাংকের নিজস্ব তহবিলে টান পড়বে। এতে তারল্যঘাটতিতে পড়ে কিছু ব্যাংক আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা রাখতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে তথা জুনের শেষে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা বেড়েছে।
চড়া মূল্যস্ফীতির হার ঠেকাতে উন্নত দেশগুলো সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি সীমিত হয়েছে। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রবাসী আয়ের প্রবাহও আশাজাগানিয়া নয়।
অনেক কারখানায় এখন গ্যাসের সংকট মারাত্মক আকার। দূরদৃষ্টির অভাব জ্বালানিনিরাপত্তাকে চাপে ফেলেছে। উৎপাদন স্থাপনা করা হলেও মৌলিক জ্বালানির জন্য আমদানিনির্ভরতা, গ্যাস উত্তোলন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সঞ্চালনব্যবস্থায় যথাযথ বিনিয়োগ না হওয়ায় বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি বিভাগ দ্রুত সমাধানের পথ দেখছে না।
কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কমেছে এবং উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সারসহ উপকরণের বাজারও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কৃষকের অর্থায়ন দরকার। অনেক কর্মসংস্থান তৈরি করলেও ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প এখনো অবহেলিত।
৪.
ভ্যাট সংগ্রহের মন্থর প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধীরগতির ইঙ্গিত দেয়। সংগ্রহের প্রবৃদ্ধিও মূল্যস্ফীতির কারণে। ডলার-সংকট ও আমদানি নিরুৎসাহিত করায় আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করেছে। যখন পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন কর ফাঁকিও বেড়ে যায়। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশি হারে বাড়ে। এর সঙ্গে রয়েছে চলমান পুঁজি পাচার।
সরকারের জন্য সর্বোত্তম উপায় হলো বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে চলমান কর ফাঁকি রোধ করা। সরকার নিজেই কর সংস্কার কর্মসূচিতে মনোনিবেশ না করে রাজস্ব আয়ের আঁটসাঁট অবস্থানে পর্যবসিত করেছে। কম কর আদায়ের কারণে সরকারের আর্থিক অবস্থান সংকুচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ রেকর্ড এক লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ায় মুদ্রিত অর্থ বাজারে প্রবেশ করছে। ভোক্তাদের মূল্যস্তরকে আরও বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।
বলা বাহুল্য, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরে ৫১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার ছিল। এক বছরে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। অনুমান করা হচ্ছে যে ২০২৩ সালের শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়ে ১১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালের শেষে বাংলাদেশের ঘাড়ে ১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণের বোঝা তৈরি হবে।
শর্ত না বুঝে ও নানা ধরনের ত্রুটিসহ বৈদেশিক ঋণের চুক্তি স্বাক্ষর, প্রকল্প তৈরি, অনুমোদন এবং তদারকির ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি, উন্নয়ন সহযোগীদের আমলাতান্ত্রিকতাসহ নানা কারণে বৈদেশিক অর্থছাড় কম। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এখন জমা আছে ৫০ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে অনেক দিন থেকে উন্নয়ন ব্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন জায়মান। ব্যয়ের রাশ টেনে ধরা না গেলে প্রকল্পগুলো বোঝায় পরিণত হতে পারে।
৫.
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে সরকারের গৃহীত নীতি–কৌশলের ধরনের ওপর। গতানুগতিক সনাতন নীতি–কৌশলকে সক্রিয় নিষ্ক্রিয়তা হিসেবে দেখা হয়। সরকারি নীতি-কৌশলে সক্রিয় প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে অপেক্ষাকৃত মানবিক ও সমতাভিত্তিক পুনরুদ্ধার সম্ভব।
অন্যথায় অর্থনীতি চরম বৈষম্যমূলক পুনরুদ্ধারের পথে যাবে। পুনরুদ্ধার গতিপথ ক্রমেই ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের চেহারা ধারণ করে অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হবে এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়বে। এই প্রক্রিয়ায় সমাজে বিভেদ, বৈষম্য এবং মেরুকরণ ত্বরান্বিত হবে। এ পরিবর্তন রোধ নির্ভর করবে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ওপর।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন