একটা মারাত্মক কাজের কাজ করেছে যশোরের চৌগাছা উপজেলা প্রশাসন। চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেছে। নাতি থেকে দাদু, চোর থেকে সাধু—সবাই ‘সাধু! সাধু!’ বলছে।
ঘটনা হলো, আগামী ১৫ জানুয়ারি থেকে চৌগাছায় তিন দিনব্যাপী খেজুর গুড় মেলা শুরু হবে।
এই মেলাকে সামনে রেখে উপজেলা প্রশাসন মঙ্গলবার (৮ জানুয়ারি, ২০২৪) একটি গাছি সমাবেশের আয়োজন করেছে।
ভেজালের মশা মাছি যাতে গুড়ে উড়ে এসে জুড়ে বসতে না পারে, সে জন্য ছিল এই গাছি সমাবেশ। মোট ১১০ জন গাছি সেখানে হাজির ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ যুবক, কেউ মধ্যবয়সী, কেউ বৃদ্ধ।
নৈতিকভাবে তাঁরা যাতে বেলাইনে চলে না যান, সে জন্য তাঁদের লাইনে দাঁড় করিয়ে শপথবাক্য পড়ানো হয়েছে।
শপথবাক্য পড়িয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুস্মিতা সাহা। ছেলেপেলে ইশকুলে বাহু তুলে যে কায়দায় ‘আমি শপথ করিতেছি যে...’ পাঠ করে, সেই কায়দায় তিনি গাছিদের শপথবাক্য পড়িয়েছেন: ‘শপথ করছি যে, খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষার্থে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল গুড় উৎপাদনে বদ্ধ পরিকর থাকব। গুড় তৈরির সময় ক্ষতিকর কোনো কিছু ব্যবহার করব না। বিশেষ করে চিনি বা ক্ষতিকর কোনো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করব না বা আখের গুড় মিশ্রিত করব না। গুড় উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখব এবং সর্বদা দেশের কল্যাণে নিয়োজিত থাকব।’
রসের খেজুর গুড়ের চেহারা নিয়ে ‘চিনির খেজুর গুড়ে’ যখন বাজার সয়লাব; জাল ও ভেজাল গুড় খেয়ে সারাক্ষণ পেট গুড় গুড় করার যন্ত্রণা যখন অতি মামুলি ঘটনা; তখন গুড়াসক্ত লোকেরা এই ধরনের গুড় বিষয়ক শপথবাক্যে গভীর গুঢ়ার্থ খুঁজবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী!
এমপি-মন্ত্রী বা সাংবিধানিক পদে পদস্থ হওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে যে শপথ পড়তে হয়, আমরা সে কিসিমের শপথের দিকে যাচ্ছি না। আমরা মূলত গরিব গাছিদের শপথের কথা বলছি।
এই শপথ মূলত কিরে কেটে কড়ার দেওয়া ধরনের শপথ; অসাধু হিসেবে পাবলিকের সন্দেহের তিরের সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির সাধু থাকার অঙ্গীকার তথা কথা দেওয়ার শপথ।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্পের প্রধান চরিত্র ধুরন্ধর মোতালেফ গাছি কুবুদ্ধি করে গুড় বানানোর জন্য মাজু খাতুনকে বিয়ে করলেও গুড়ে ভেজাল দেওয়ার কুবুদ্ধি তার ছিল না। কারণ খেজুর গুড়ে ভেজাল দেওয়ার হুজুগ সে যুগে ছিল না।
এখন চালাক লোকের যুগ। এখন বাজারে খ্যাপলা জালের খ্যাও দিয়েও নির্ভেজাল খেজুর গুড় পাওয়ার চান্স প্রায় জিরো।
এ কারণে গাছির তাফালে হালকা আঁচে জ্বাল দিয়ে বানানো গুড় আর রসের ওপর ভরসা করা কঠিন।
এই অবস্থায় চৌগাছার ইউএনও গাছিদের এক জায়গায় জড়ো করেছেন; তাদের মধ্যে আত্মশুদ্ধির ভাব জাগিয়ে বিশুদ্ধ গুড় তৈরির কড়ার আদায় করেছেন; এটা কিন্তু কম ইসের কথা না।
কিন্তু উপলব্ধির অন্তরলোকে একটি প্রশ্ন খানিকক্ষণ পর পর উঁকিঝুঁকি মেরে যাচ্ছে।
সেটি হলো, কয়েকটি কাতারে দাঁড় করিয়ে এই যে গরিব গাছিদের দিয়ে গুড়ে ভেজাল না মেশানোর শপথবাক্য পড়ানো এবং সে খবর সংবাদমাধ্যমে ছড়ানো হলো, ঠিক একইভাবে কি কোনো দিন কোনো শাসক বা প্রশাসক ‘ব্যবসায়ী সমাবেশ’ ডেকে বড় বড় শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীদের খাদ্যে বা পণ্যে ভেজাল না দেওয়ার ‘শপথবাক্য’ পাঠ করাতে পারবেন?
গত তিনটি সংসদ নির্বাচনে কীভাবে ভোট হয়েছে, তা সবার ঠোঁটে আছে।
গত ১৫ বছর ধরে ইউপি থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারা দাঁড়িয়েছিলেন এবং কীভাবে তাঁরা ‘জনপ্রতিনিধি’ হয়েছিলেন, সেই সত্য সবাই জানে এবং মানে।
এই সব নাটক মার্কা ভোটের পোলিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসার ও ঊর্ধ্বতন সব কর্মকর্তা নির্বাচনের গুড়ে বালি মিশিয়েছিলেন।
নির্বাচনকে ক্ষমতা আর টাকায় মুড়ে ভোটের গুড়ে বালি দেওয়ার তুলনায় খেজুর গুড়ে চিনি মেশানো কি বেশি খারাপ?
সেই সন্দেহ দূর করতে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব সরকারের কাছে জমা দিতে যে সময় দেওয়া হয়েছিল, তা পার হয়ে গেছে। এখন নতুন করে সময় দেওয়া হয়েছে। তাদের সম্পদের হিসাব দিতে এত সময় লাগবে কেন? এই প্রশ্নকে ঠেসে রাখলেও তা পাবলিকের মাথা উঠে দাঁড়াবে। পাবলিক বলবে, সরকারের যে আমলারা গরিব গাছিদের শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন, তাঁদেরও লাইনে দাঁড় করিয়ে শপথবাক্য পাঠ করালে ভালো হতো।
গুড় মেলাকে সামনে রেখে যদি ‘গাছি সমাবেশ’-এর আয়োজন করে গাছিদের শপথবাক্য পাঠ করানো যায়, তাহলে নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন ‘নির্বাচন কর্মকর্তা সমাবেশ’ করা যাবে না এবং সেই সমাবেশে কেন জনগণের সন্দেহের তিরে জর্জরিত নির্বাচন কর্মকর্তাদের একই কায়দায় লাইনে দাঁড় করিয়ে আত্মশুদ্ধিমূলক শপথবাক্য পাঠ করানো যাবে না?
কেন তাঁদের দিয়ে পাঠ করানো যাবে না, ‘আমি শপথ করিতেছি যে, ভোটের সময় দুই নম্বরি করিব না’? এ
কজন গাছির গুড়ের বিশুদ্ধতা নিয়ে লোকের মনে-দেহে যে সন্দেহ আছে, আচমকা ফাঁকা থেকে টাকার পাহাড়ের মালিক হয়ে ওঠা একজন সরকারি কর্মচারীর সম্পদের স্বচ্ছতা নিয়ে তার চেয়ে বেশি সন্দেহ আছে।
সেই সন্দেহ দূর করতে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব সরকারের কাছে জমা দিতে যে সময় দেওয়া হয়েছিল, তা পার হয়ে গেছে। এখন নতুন করে সময় দেওয়া হয়েছে।
তাদের সম্পদের হিসাব দিতে এত সময় লাগবে কেন? এই প্রশ্নকে ঠেসে রাখলেও তা পাবলিকের মাথা উঠে দাঁড়াবে।
পাবলিক বলবে, সরকারের যে আমলারা গরিব গাছিদের শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন, তাঁদেরও লাইনে দাঁড় করিয়ে শপথবাক্য পাঠ করালে ভালো হতো।
তাতে যদি কেউ মনে করে অফিসারদের জাত যাবে, তাহলে বুঝতে হবে ‘জাতের’ তেজারতি শুধু তাদেরই আছে; গাছিদের যাওয়ার মতো জাত নেই। অথচ শপথবাক্য পাঠ করা ‘গাছিরা’ই দেশের মালিক; শপথবাক্য পাঠ করানো আমলারা তাঁদের কর্মচারী।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ইমেইল: [email protected]