দেশে এখন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকার তার আরাধ্য কাজ শেষ করে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেবে। ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো একটি নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে।
অনেক দিন ধরেই জন-আলোচনায় আছে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’। ৫৩ বছর ধরে দেশে চলে এসেছে এক ব্যক্তির শাসন। ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিবার ও গোষ্ঠীগুলো পালাক্রমে আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে ছিল। আমরা সেখান থেকে পরিত্রাণ চেয়েছি। এ বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে ৫ আগস্ট ঘটে গেছে এক অভূতপূর্ব পালাবদল। আমরা বলছি, আমরা আগের অবস্থায় আর ফিরে যেতে চাই না। আমরা একটা ‘রিসেট বাটন’ টিপে অতীতের রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে ছেদ ঘটিয়েছি। আমরা একটা বৈষম্যহীন নতুন সমাজ গড়তে চাই। এ জন্য চাই নতুন ধারার রাজনীতি।
প্রশ্ন হলো, পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো কি নতুন ধারার রাজনীতি গ্রহণ করবে? তারা কি রিসেট বাটন টিপে অতীতের চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসবে? যদি না আসে, তাহলে নতুন সমাজের আকাঙ্ক্ষা তারা কীভাবে ধারণ করবে?
সম্প্রতি নাগরিক সমাজের এবং সরকারের কর্তা-উপদেষ্টাদের কথাবার্তায় সংস্কারের বিষয়টি জোরালোভাবে এসেছে। এমনও কথা উঠেছে, যদি রাষ্ট্র মেরামত না হয়, যদি সবকিছু আগের ধারাতেই চলতে থাকে, অর্থাৎ একটা দলের হাত থেকে আরেকটা দলের কাছে ক্ষমতা যায়, তাহলে এত লোক কেন প্রাণ দিলেন? চব্বিশের জুলাই-আগস্ট তো নিছক সরকার বদলের আন্দোলন ছিল না। এটা তো ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের আন্দোলন।
অন্তর্বর্তী সরকার বেশি দিন ধরে চলতে পারে না। একটা রাজনৈতিক সরকারের দিকে আমাদের যেতেই হবে। কথা হলো, কত দিনের মধ্যে যাব এবং সেটা কেমন রাজনীতি হবে।
সরকারের কেউ কেউ বলছেন, ন্যূনতম সংস্কার করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা মীমাংসায় যেতে হবে। তারপর হবে নির্বাচন। অনেক রাজনীতিবিদ এটা মানতে চান না। তাঁরা মনে করেন, সংস্কারপ্রক্রিয়া চালু করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো রাজনৈতিক সরকারের দায়িত্ব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে, তারাই সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে। একটি ‘অনির্বাচিত সরকারের’ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়। সংস্কারের কাজে তাদের ম্যান্ডেটও নেই। ইতিমধ্যে সংস্কারের নামে কালক্ষেপণের অভিযোগ উঠেছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে। ‘আপনারা নির্বাচন দিয়ে চলে যান’, এমন কথাও বলছেন কেউ কেউ।
৭০ অনুচ্ছেদে কী আছে? ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি…সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে…।’ সংবিধানে এ রকম একটি ধারা থাকলে কোনো সদস্য তাঁর নেতার ইচ্ছার বিপক্ষে যাওয়ার সাহস দেখাবেন না।
দেশে এখন ছোট-বড় যে রাজনৈতিক দলগুলো দৃশ্যমান ও সক্রিয়, তারা সবাই সংস্কারের পক্ষে। তারা অনেকেই বলছে, সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি পাশাপাশি চলতে পারে এবং অল্প কিছু বিষয় ছাড়া বাকি সংস্কারগুলো এগিয়ে নেবে নির্বাচিত সরকার। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিএনপি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, তাঁরা অনেক দিন ধরেই সংস্কারের কথা বলে আসছেন। তাঁদের ৩১ দফা কর্মসূচির মধ্যেই আছে সংস্কার প্রস্তাব। নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে তাঁরা তাঁদের ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। তাহলেই সব সমস্যার সুরাহা হবে।
৩১ দফা তো অনেক বড় রকমের কর্মসূচি। আমি পড়ে দেখেছি, এতে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব আছে, কিছু আছে ভাসা–ভাসা কথা এবং সর্বোপরি আছে কিছু ইচ্ছা বা ‘ইনটেনশন’। প্রশ্ন হলো, ক্ষমতায় গেলে তাঁরা এই কর্মসূচি বা অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়ন করবেন কি না। অতীতে দেখেছি, নির্বাচনের আগে দলগুলো প্রতিশ্রুতির ফর্দ নিয়ে হাজির হয়। পুরো মেয়াদকালে তারা একটা কাজই মন দিয়ে করে। আর সেটা হলো, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির সমালোচনা ও গিবত।
আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে রোজ রোজ একটা রেকর্ডই বাজাত, ২১ বছর তারা অনাহারে ছিল। ওই সময় দেশে দুর্বৃত্তদের রাজত্ব ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে একই রেকর্ড বাজিয়েছে, ১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী দুঃশাসনে মানুষ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। আর এক-এগারো নিয়ে ছিল উভয় দলের আহাজারি, মিলিটারিরা (অনির্বাচিত সরকার) দেশকে হাজার বছর পিছিয়ে দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো অতীতের জাবরকাটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। আগামী ১০, ২০ বা ৫০ বছর পর আমরা কোথায় যেতে চাই; এ জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের কেমন পরিকল্পনা নিতে হবে, এ নিয়ে আলোচনা নেই। কথাবার্তা সব অতীতকে ঘিরে; তুমি অমুক সালে আমাকে এই বলে গাল দিয়েছ, কিংবা তুমি অমুক দিন আমার দিকে ট্যারা চোখে তাকিয়েছ। অতীতাশ্রয়ী মনস্তত্ত্বের ঘেরাটোপে যেন সবাই বন্দী হয়ে আছেন। সামনের দিনগুলো তাঁরা দেখতে পান না।
গণতন্ত্রের মানে কী? প্রথমত, এটা জনগণের শাসন, অর্থাৎ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র চালাবেন। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে। একবার নির্বাচিত হয়ে গেলেই জমিদারি পেয়ে যাওয়ার চিন্তাটা বাদ দিতে হবে।
প্রথমটির জন্য আবশ্যিক শর্ত হলো, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। দলীয় সরকারের অধীনে এটা কখনোই হয়নি বলে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। দৃশ্যপটে এখন আওয়ামী লীগ নেই। অন্য দলগুলো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে মোটামুটি একমত।
দ্বিতীয় বিষয়টি নিশ্চিত করা যায় একটা জবাবদিহিমূলক সরকারব্যবস্থা থাকলে। তার মানে, নির্বাচন হয়ে গেলেই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটা দলীয় সিন্ডিকেট বানিয়ে ক্ষমতা কবজা করে নেবেন, এটি হবে না। নাগরিকদের কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। এ দুটি বিষয়ের নিষ্পত্তি হলে বলতে পারব যে আমরা একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রথম সিঁড়িটি পার হয়েছি।
আমাদের দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে প্রকৃতপক্ষে শুধু একদলীয় নয়, বরং এক ব্যক্তির শাসন দেখেছি। দেশ চলেছে শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মর্জিমাফিক।
প্রশ্ন হলো, এটা কীভাবে সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে একদিকে তাঁদের মধ্যে ছিল ক্ষমতালিপ্সা, অন্যদিকে তাঁদের পক্ষে ছিল সাংবিধানিক সুরক্ষা। সংবিধানেই এমন সব ধারা সংযোজিত হয়েছিল, যার বলে এবং ফলে এক ব্যক্তির শাসন জায়েজ করা গেছে। সংবিধানের ‘৭০ অনুচ্ছেদ’ হচ্ছে সেই জাদুর কাঠি, যখন যাঁর হাতে থাকে, তিনি অসীম ক্ষমতার মালিক হয়ে যান।
এ দেশে যিনি দলের প্রধান, তিনিই সরকারের প্রধান। কার ঘাড়ে কয়টা মাথা আছে যে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে? নেতার কথাই শেষ কথা। নেতার বিরোধিতা করা মানে দলে অচ্ছুত হয়ে যাওয়া কিংবা বাদ পড়া। এ যেন ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’। যাঁরাই ঝুঁকি নিয়ে নেতার ইচ্ছার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁকে সে জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। উদাহরণগুলো আর নাই–বা দিলাম।
৭০ অনুচ্ছেদে কী আছে? ‘কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি…সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে…।’ সংবিধানে এ রকম একটি ধারা থাকলে কোনো সদস্য তাঁর নেতার ইচ্ছার বিপক্ষে যাওয়ার সাহস দেখাবেন না।
সংবিধানের ৭০ ধারা বাতিলের প্রস্তাব উঠেছে অনেক দিন থেকেই। এ ব্যাপারে বিএনপিকে দোনোমনা দেখা যাচ্ছে। বিএনপি বলছে, তাদের ৩১ দফায় সব রোগের ওষুধ আছে। তো ৭০ ধারা সম্পর্কে তাদের অবস্থান কী?
তাদের ৩১ দফা প্রস্তাবের ৬ নম্বর দফায় আছে, ‘আস্থা ভোট, অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন সব বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে।’
তার মানে, বিএনপি এখনো এটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে তাঁরা আর কত সময় নেবেন? তাঁরা কি পরবর্তী নির্বাচনের আগে এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসবেন? তাঁরা যদি নির্বাচনে জয়ী হয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পুরো মেয়াদ পার করে দেন, তখন কী হবে? তাঁরা তো বলবেন, ‘আমরা কথা রেখেছি, আমরা এ নিয়ে ভাবছি।’
সংবিধান থেকে ৭০ অনুচ্ছেদ উঠে যাওয়ার মানে হলো দলনেতার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কাটছাঁট হয়ে যাওয়া। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় ব্যক্তির একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। বিএনপি যদি ‘এক ব্যক্তির শাসন’ না চায়, তাহলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে তাঁদেরকে খোলামেলা কথা বলতে হবে।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক