ফ্রিল্যান্সার সাধারণত এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নির্দিষ্ট কোনো নিয়োগকর্তার কাছে দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হয়ে স্বাধীনভাবে নিজেই কাজ করেন। সেই কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পান।
২০১৭ সালে অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ২৪ শতাংশ ফ্রিল্যান্সার ভারতের এবং ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের। ভারতের অবস্থান প্রথম, বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বরাবরের মতোই সংখ্যা নিয়ে উচ্ছ্বসিত আমরা ‘দ্বিতীয় দ্বিতীয়’ বলে শোরগোল তুলতে থাকলাম। গুণগত মান নিয়ে কথা বলার জন্য কোথাও কেউ ছিল না। এখনো কেউ নেই।
শহরের এবাড়ি–ওবাড়ির ছাদে শুধু টাওয়ার আর টাওয়ার, মোবাইল অপারেটরদের টাওয়ার। দেশের বেশির ভাগ জায়গা চলে এসেছে নেটওয়ার্কের আওতায়। অলিগলিতে মাথার ওপর দৃষ্টিকটুভাবে ঝুলে থাকা কুণ্ডলী পাকানো তারের সংখ্যাও বেড়ে চলছে সমানতালে। জেলায়-উপজেলায় নির্মিত হচ্ছে ল্যাব, পার্ক, ইনকিউবেশন সেন্টারসহ আরও কী কী আধুনিক নামের সব স্থাপনা।
দেশে তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো প্রস্তুতের প্রয়োজন বেড়েছে, প্রয়োজনের চেয়েও বেশি বেড়েছে আয়োজন। কিন্তু শুধু অবকাঠামোয় ভর করে তৈরি হয়ে যাবে ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশ?
জ্ঞানভিত্তিক যে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কথা বলা হচ্ছে, সে পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সম্পদ, সে ‘মানবসম্পদ’ প্রস্তুতের আয়োজনে কি এগিয়ে যেতে পারছি আমরা? বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রে আমাদের জেলায় জেলায় টাওয়ার হয়েছে, ফাইবার অপটিক সংযোগ হয়েছে, নেটওয়ার্ক হয়েছে; কিন্তু ৬৪ জেলা থেকে ৬৪ জন করে প্রথম সারির সাইবার নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞ, উপাত্তবিজ্ঞানী, মেশিন লার্নিং প্রকৌশলী কিংবা ৬৪ জন ডেটা সেন্টার–বিশেষজ্ঞ কি তৈরি হয়েছে?
সম্প্রতি সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন ফ্রিল্যান্সার নিয়োগের জন্য শীর্ষ ৩০টি দেশের তালিকা তৈরি করেছে। তালিকার প্রথম স্থানে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের অবস্থান ওপরের দিক থেকে দ্বিতীয় আর বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়, অর্থাৎ ২৯তম। বাংলাদেশের স্কোর ১০০–এর মধ্যে ৪৬ দশমিক ৯২, যেখানে ভারতের স্কোর ৯৫ দশমিক ৭১। প্রথম স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের স্কোর ৯৭ দশমিক ৪৬।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দক্ষতা, সে দক্ষতায় অর্থাৎ ‘মানবসম্পদ’ তৈরিতে আমরা পিছিয়ে পড়ছি উদ্বেগজনক হারে। সিসকো ডিজিটাল প্রস্তুতি সূচক ২০২১ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। সেই সূচকের মানবপুঁজি ও স্টার্টআপ পরিবেশ শ্রেণিতে বাংলাদেশের অবস্থান যথাক্রমে ১১৮ ও ১৪৪তম।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে এখন আর কিছু একটা শিখে বসে থাকার সুযোগ নেই। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল দক্ষতার বাজারে নিত্যনতুন দক্ষতা, প্রশিক্ষণ নিতে না পারলে সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তন করতে না পারলে, ক্রমাগত আমরা পেছাতেই থাকব
উদীয়মান যেসব প্রযুক্তির কথা এখন আলোচিত হচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার শক্ত ভিত্তি না থাকলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে বা কয়েক মাসের প্রশিক্ষণ করে সেগুলোয় নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন। প্রাইমারি ক্লাসে কোডিং যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু প্রাথমিকের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা কি করা হয়েছে? প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে এশিয়ায় শেষের দিকের অবস্থানে আছে বাংলাদেশ (বণিক বার্তা, মে ২৬, ২০২৪)। ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে হাতেনাতেই।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণা জরিপ বলছে, তৃতীয় শ্রেণির ৭৬ শতাংশ ও চতুর্থ শ্রেণির প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলাই ঠিকমতো পড়তে পারে না। তৃতীয় শ্রেণিতে ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী সংখ্যা চিনতে পারে না (প্রথম আলো, ২৫ মার্চ, ২০২৪)।
জ্ঞানভিত্তিক বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় শুধু দৈহিক শ্রম দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। যে সস্তা শ্রম থেকে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি, অটোমেশনের প্রভাবে সেটিও হুমকির মুখে।
এটুআইয়ের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে গার্মেন্টস খাতের ৬০ শতাংশ চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়বে। প্রযুক্তি সৃষ্টির দক্ষতা দূরে থাক, প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা অর্জনেও আমাদের অবস্থা সুখকর নয়। জিএসএমএর ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ নারী ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে জানেন, কিন্তু তারপরও তাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। ব্যবহার না করার প্রথম কারণ আর্থিক সামর্থ্যের অভাব নয়, বরং ডিজিটাল সাক্ষরতা ও দক্ষতার অভাব।
অবকাঠামো তৈরি করে দেওয়ার জন্য বিক্রেতা আছে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট আছে, লবিস্ট আছে। কিন্তু আমাদের মানবসম্পদ তৈরির জন্য কোনো তাগাদা কিংবা তাড়না কি তাদের আছে? আমরা কি শুধু দরপত্র আহ্বান করে অবকাঠামোসামগ্রী কিনতে থাকব আর ব্যবহারকারী হয়ে বাজার বানাব বিদেশি পণ্য ও প্রযুক্তির?
সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বেসিসের সদস্যসংখ্যা ২ হাজার ৫০০–এর বেশি। এর মধ্যে ২৫টি মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানও কি পাওয়া যাবে, যারা সাইবার নিরাপত্তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অথবা উপাত্ত বিশ্লেষণ নিয়ে বিশেষ অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে? প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই যদি আমরা পিছিয়ে পড়ি, ব্যক্তিপর্যায়ের ফ্রিল্যান্সিংয়ে এগোনোর পথ তো আরও কঠিন।
অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে প্রচুর কাজ এখন যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। সেখানে সুযোগ কমছে ফ্রি ল্যান্সারদের। ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে এখন আর কিছু একটা শিখে বসে থাকার সুযোগ নেই।
প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল দক্ষতার বাজারে নিত্যনতুন দক্ষতা, প্রশিক্ষণ নিতে না পারলে সে অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তন করতে না পারলে, ক্রমাগত আমরা পেছাতেই থাকব। সেই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে প্রয়োজন হবে দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়া। সেটি না হলে অনেক দূর থেকে তাকিয়ে থাকার মধ্যেই আমাদের ‘স্মার্ট ভিশন’ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, সেটি ছুঁয়ে দেখা অলীক কল্পনাই থেকে যাবে। টাওয়ারে ভর করে স্মার্ট হওয়া যায় না, দক্ষতায় ভর করে স্মার্ট হতে হয়।
● ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক