সিরিয়ার খবর গণমাধ্যমের প্রথম পাতা থেকে সরে গেলেও সেখানকার সংঘাত এখনো সমানতালেই চলছে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্যে রেখে সিরিয়ার সরকার ও বিদ্রোহীরা একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে গেলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর একটি জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করতে হবে। অবশ্য শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো তৎপরতা শুরু হলে দেশটির পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দাবানলের মতো প্রতিক্রিয়া ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বাইরের শক্তিগুলো আরও বেশি করে নাক গলানোর সুযোগ পায়।
গত সপ্তাহে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, গত বছর তিনি সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এক দশকের বেশি আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর দুই পক্ষের মধ্যে সেটিই প্রথম বৈঠক। আঙ্কারায় একটি সংবাদ সম্মেলনে মেভলিত সাভাসগলু এমন কিছু বলেছেন, যেটাকে ‘ষড়যন্ত্রের’ চেয়েও বেশি কিছু বলা যায়। তিনি বলেন, ‘যেভাবেই হোক সিরিয়ার বর্তমান শাসক ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে একটা চুক্তির পথ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। সিরিয়ায় অবশ্যই একটা শক্তিশালী প্রশাসন থাকতে হবে...যে প্রশাসন দেশটির প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।’
গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, সিরিয়া এবং বাইরের শক্তির মধ্যকার বিরোধের কারণে প্রথমে ঘোষিত অনেক নীতিই পরবর্তীকালে বদলে যায়। সাভাসগলুর বক্তব্যের পর সিরিয়া ও তুরস্কে বসবাসকারী সিরিয়ানরা যে ধৈর্য ধরে বসে থাকবেন না, তা প্রত্যাশিত ছিল। তুরস্কনিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে এখন প্রতিবাদ হচ্ছে। সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ অঞ্চলে অবস্থান করছে। সিরিয়ার বাকি অংশের বেশির ভাগের নিয়ন্ত্রণ বাশার আল–আসাদ সরকারের।
সিরিয়ার সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আসতে চাওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের যুক্তি উপেক্ষা করা যায় না। সাভাসগলুর বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে সিরিয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কের নীতিতে উল্লেখযোগ্য একটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এত দিন ধরে সশস্ত্র একটি গোষ্ঠীকে পরাজিত করার জন্য মিত্রকে পরিত্যাগের নীতিতে চলেছে আঙ্কারা। সাভাসগলুর মন্তব্য থেকে প্রথমবারের মতো একটা ইঙ্গিত বেরিয়ে এল যে তুরস্ক তাদের সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষাবলয়ে সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের বসতি স্থাপনের যে পরিকল্পনা করেছিল, সেখান থেকে সরে আসতে যাচ্ছে। তেহরানে ভ্লাদিমির পুতিন, ইব্রাহিম রাইসি ও রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মধ্যে বৈঠকের কিছুদিনের মধ্যেই এমন ইঙ্গিত মিলল।
আবার সবকিছু যে তুরস্কের ওপর নির্ভর করছে, এমন নয়। সিরিয়ার সরকার কোন বিষয়টির চেয়ে কোন বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আসাদ সরকারের কাছে তুরস্ক–নিয়ন্ত্রিত ছিটমহল থেকে পূর্বাঞ্চলের মার্কিন প্রভাবাধীন কুর্দি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তুরস্ক একটা উভয়সংকটে পড়েছে।
২০১৬ সাল থেকে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে তিনটি ছিটমহল সুরক্ষিত করে রেখেছে আঙ্কারা। এই ছিটমহলগুলোতে যেসব সিরিয়ান তুরস্কে শরণার্থী হতে চান, তাঁদের রাখা হয়। তাঁদের সন্তানেরা তুরস্কের তৈরি করা স্কুলে পড়ে। তুর্কি গভর্নর–শাসিত এসব ছিটমহলে তুরস্কের মুদ্রা চালু আছে। সেখানকার সিরিয়ান সেনাদের বেতন-ভাতা দেয় তুরস্কের সরকার।
সিরিয়াকে নিয়ে তুরস্কের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হলো তুরস্ক থেকে কয়েক লাখ সিরিয়ান শরণার্থীকে ফেরত পাঠানো আর সীমান্ত থেকে কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পিছু হটানো। তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখন শরণার্থী সংকট বড় একটা সমস্যা হয়ে উঠেছে। শরণার্থীদের নিয়ে সেখানে জনমনে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ কারণে হেরেও যেতে পারেন।
তুরস্ক এখন বাশার আল–আসাদ ও বিরোধীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হয়, তবে ছিটমহল প্রকল্প থেকে তাদের সরে আসতে হতে পারে। সেটা করা আঙ্কারার জন্য খুব সহজ নয়। কেননা সেসব ছিটমহলে থাকা সিরীয়রা কেউ সিরিয়ার শাসনের অধীনে ফিরতে চান না। তাঁরা কারাগারে যাওয়ার কিংবা আরও খারাপ কিছু ঘটার শঙ্কা করেন। সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির ৫০ হাজার বিদ্রোহীর মধ্যেও একই শঙ্কা রয়েছে। এই বিদ্রোহীরা তুরস্কের অর্থায়নে চলেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সেখানে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে ওই এলাকা আসাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদ্রোহী সেনাদেরও একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। তাতে করে উত্তেজনার পারদ সেখানে চড়ছে।
কুর্দিদের মধ্যে স্বতন্ত্র মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে। তুরস্কের ভেতরে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) বিদ্রোহীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চলছে আঙ্কারার। সীমান্তের ওপারের কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠী পিকেকের সঙ্গে মিলে যাক, তা চায় না তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে কুর্দি সশস্ত্র যোদ্ধারা সিরিয়ার পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ বিশাল একটা এলাকার নিয়ন্ত্রণ করে। এখন স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের পথ বন্ধ করতে গেলে আসাদের সঙ্গে মৈত্রী প্রয়োজন এরদোয়ানের। সে ক্ষেত্রে ছিটমহলের মায়া ত্যাগের পাশাপাশি তুরস্ক সমর্থিত বিদ্রোহীদের নিবৃত্ত করার প্রয়োজন হবে আঙ্কারার।
আবার সবকিছু যে তুরস্কের ওপর নির্ভর করছে, এমন নয়। সিরিয়ার সরকার কোন বিষয়টির চেয়ে কোন বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। আসাদ সরকারের কাছে তুরস্ক–নিয়ন্ত্রিত ছিটমহল থেকে পূর্বাঞ্চলের মার্কিন প্রভাবাধীন কুর্দি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তুরস্ক একটা উভয়সংকটে পড়েছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ফয়সাল আল ইয়াফি লেখক ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক