৩৬ জুলাই, মতান্তরে ৫ আগস্ট দেশে একটা বিরাট ওলট-পালট হয়ে গেছে। একটা প্রচণ্ড জনবিদ্রোহ হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কেউ কেউ বলছেন, এটা একটা বিপ্লব। সচরাচর আমরা দেখি, বিপ্লব হলে অতীতের সঙ্গে একটা বড় রকম ছেদ পড়ে। সবকিছু ভেঙেচুরে নতুন করে শুরু করতে হয়। আমরা এখন ভেঙেচুরে নতুন করে নির্মাণ করার কথা বলছি না। আমরা বলছি সংস্কারের কথা, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা।
রাষ্ট্রের নানান সমস্যা, অসামঞ্জস্য, বৈষম্য, ঘাটতি—এগুলো নিয়ে অনেক বছর ধরে নাগরিকেরা সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু আমাদের শাসকেরা তাতে কোনো দিন কান দেননি। ছাত্র-জনতার বিদ্রোহে নাগরিকদের সামনে একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সবাই।
কিন্তু নানা কারণে আমাদের মধ্যে আশঙ্কা জাগে। কারণ, এ ধরনের জনবিদ্রোহ আগেও হয়েছে। কিন্তু ফসল সব সময় জনগণের কাছে আসেনি। প্রচণ্ড রকম অস্বস্তিকর ও শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিস্থিতির মধ্যে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে একটা সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম, সে সময় যারা সরকারে ছিল, সেই সরকারি দল ও তাদের সহযোগীরা ছাড়া সবাই এ অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র আগের মতোই থেকে গিয়েছিল। পরবর্তী শাসকেরা সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জনগণকে শাসন করেছেন।
১৯৯০ সালে দেশে একটা গণ-অভ্যুত্থান দেখেছিলাম। এরপর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটা অন্তর্বর্তী সরকার হলো। আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হয়েছিল একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসে, আর নাগরিকেরা স্বাধীন হলেন নব্বইয়ের ডিসেম্বরে। সেই স্বাধীনতা নাগরিকেরা ভোগ করতে পারলেন মাত্র কয়েক মাস। তারপর আবার সেই খাড়া বড়ি থোড়, থোড় বড়ি খাড়া। সেই আবার এক দলের শাসন, এক ব্যক্তির শাসন। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে আগে যেভাবে, যে পদ্ধতিতে সমাজকে এবং মানুষের কাজ ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো, সেটা অব্যাহত থাকল।
একপর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন হলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এল। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে কারসাজি করে নিজেদের পক্ষে ব্যবহারের নানা চেষ্টা হলো। বিএনপি, আওয়ামী লীগ—দুই দলই ধারাবাহিকভাবে সেটা করল। ফলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি পচে গেল। এর ফলে এক-এগারোর বিরাট একটা ধাক্কা এল। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এখান থেকেও শিক্ষা নেয়নি।
১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে যে শাসনব্যবস্থা ছিল, সেটাকে এককথায় বলা যায় ফ্যাসিবাদ। সবকিছু একটি গোষ্ঠী নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে এবং সে জন্য তারা নির্বিচার দমন–পীড়ন চালিয়েছে, মানুষ মেরেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। জুলাই-আগস্টে যে জনবিদ্রোহ হলো, তার অনুঘটক হিসেবে ছাত্র-তরুণেরা ভূমিকা পালন করেছে। অভ্যুত্থানের এক মাস পার হলো। অন্তর্বর্তী সরকার এখনো থিতু হতে পারেনি। সরকার এখন নানা অঙ্গীকারের কথা বলে যাচ্ছে। সরকারকে সংস্কারের কাজগুলো শুরু করতে হবে। সেই কাজগুলো কী?
আমরা যদি রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলি, তাহলে যেসব আইনের ফাঁকফোকর গলে সরকার জনগণকে শাসন, শোষণ ও নির্যাতন করে, প্রথমেই সেগুলো বদলাতে হবে। সেটা বদলাতে হলে প্রথমেই সংবিধানে হাত দিতে হবে। এখন সংবিধান নিয়ে নানা কথাবার্তা হচ্ছে—সংশোধনের কথা হচ্ছে, পুনর্লিখনের কথা হচ্ছে।
একটা বিপ্লব হলে সচরাচর আগের সংবিধানটাকে বাতিল করে দেওয়া হয়। আমরা এখন সেটা দেখছি না। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সংবিধান পরিমার্জন করা হবে। কিন্তু সংবিধান এমনভাবে পরিমার্জন করতে হবে, যাতে সংবিধানের দোহাই দিয়ে শাসকেরা নাগরিকদের কোনো অংশকে নির্যাতন ও শোষণ করতে না পারেন। নাগরিকেরা যেন বৈষম্যের শিকার না হন, সেই নিশ্চয়তা সংবিধানে যেন থাকে।
রাষ্ট্রের অন্যতম অংশীজন হলো রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেরা নিজেদের সংস্কার না করে, তাহলে তো রাষ্ট্র সংস্কার হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করে কি না, সেটা হচ্ছে কোটি টাকার একটি প্রশ্ন। দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা না করলে দেশে তারা কীভাবে গণতন্ত্র চালু করবে।
আমাদের দেশে বড় দল বলি আর ছোট দল বলি—সবই এক ব্যক্তি ও এক পরিবারকেন্দ্রিক। একটা মাত্র দলে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নেতৃত্বের নির্বাচন হয়। আর বাকি সব দলেই দলের নেতাই ঠিক করে দেন কমিটিতে কারা থাকবে। নেতৃত্ব বাছাইয়ের এই প্রক্রিয়া তারা বাতিল না করলে তাদের কাছে গণতন্ত্র আশা করা যায় না।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ব্যানার নিয়ে মিছিল করে, ব্যানারের একদিকে বড় করে নেতার ছবি থাকে। এর মানে হচ্ছে সেটা নেতার দল, জনতার দল নয়। এই সংস্কৃতিতে তো পরিবর্তন হতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আমরা দেখি, গর্দান ফুলিয়ে, আঙুল উঁচিয়ে নেতারা কথাবার্তা বলেন। এ চর্চা বন্ধ করা উচিত। রাজনীতিবিদদের আচরণ ও কথাবার্তার এই অভ্যাস বদল করা উচিত। এ ধরনের তর্জন–গর্জন তো শোভনীয় নয়।
আমরা সবাই বলি, একটা নির্বাচিত সরকার দেশে থাকতে হবে। অতীতে নির্বাচনের মাধ্যমে যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের আদৌ কি নির্বাচিত সরকার বলা যাবে? কারণ, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছে, সেটা তারা পালন করেনি। বরং যে প্রতিশ্রুতি তারা দেয়নি, সেটাই করেছে। কোনো দল কি নির্বাচনের আগে বলেছে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে সমালোচকদের বিরুদ্ধে কটূক্তির মামলা দেবে? কেউ কি আগে থেকে বলেছে, তারা ক্রসফায়ারের মিথ্যা ক্রিপ্ট লিখবে? কিন্তু সরকারে গিয়ে তারা এগুলো করেছে। ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধি হলেই তাঁরা একেবারে ফেরেশতা হবেন, সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
আমরা দেখেছি, সংসদ সদস্যের নামে ৩৫০ জনের একটা মালিক সমিতি তৈরি হয়েছিল। এক কক্ষবিশিষ্ট হোক আর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হোক, রাজনৈতিক নেতারা যদি নিজেদের পরিবর্তন না করেন, তাহলে তো কোনো লাভ নেই। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত এলাকাভিত্তিক বা জাতীয়ভিত্তিক মালিকানাকাঠামো তৈরি হয়েছিল, সেই শিকলকে ভাঙতে হবে একেবারে।
রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডাটা অনেক বড়, এখানে অনেক কাজ করতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবটা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে আসতে হবে। সেই প্রস্তাবগুলো হতে হবে সুনির্দিষ্ট। যেমন সংসদ এক কক্ষের হবে, নাকি দুই কক্ষের, সেটা তো সংস্কারের বিষয় নয়। তাদের বলতে হবে, সংবিধান থেকে তারা ৭০ ধারা তুলবে কি না। সংসদে কোটায় যে ৫০ জন আসেন, তাঁদের তো জনগণ নির্বাচিত করেন না। সেটা নির্বাচন করেন ৩০০ জন সংসদ সদস্য। এটা তো একটা বাজে ব্যবস্থা। এর অবসান হওয়া দরকার। সব জায়গায় এ রকম অসংগতি আছে, সেসব জঞ্জাল সরাতে হবে।
জনগণ তো নির্বাচনের জন্য পাগল হয়ে যায়নি। নির্বাচনের আগে প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে আমূল সংস্কার আনতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের শুরুটা হতে হবে ঘর থেকে, মানে রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিষ্কার ভাষায় প্রস্তাব দিতে হবে, তারা কী কী সংস্কার করবে। যেমন বিএনপির দিক থেকে একটা প্রস্তাব এসেছে, পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রেও এটা করতে হবে। তাহলে তো দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ কারও থাকে না। তাহলে নেতৃত্বে আমরা নতুন নতুন মুখ দেখতে পাব। আমাদের এখানে প্রতিটি এলাকায় মাত্র কয়েকটি পরিবার নির্বাচনের খেলাটা খেলে। বারবার ঘুরেফিরে একই মুখ নির্বাচিত হয়। এটা অবশ্যই বদলাতে হবে।
সংস্কার প্রশ্নে সবাইকে খোলাখুলি মতামত প্রকাশ করতে হবে। সবাই মিলে বসে যেটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে করবেন, তার ভিত্তিতে একটা সিটিজেন চার্টার হোক। যেসব রাজনৈতিক দল তাতে স্বাক্ষর দেবে, তারাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক