জাতির উদ্দেশে প্রথমবারের মতো ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার ১৭ দিন পর তিনি এ ভাষণ দিলেন।
ড. ইউনূসের এ ভাষণ দেওয়ার পরপরই বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা যায়। সর্বত্রই ভাষণের প্রশংসা চলছে। নেট–দুনিয়ায় তুমুল প্রশংসা। অনেকে বলাবলি করছেন, বহুদিন পর জাতির উদ্দেশে এ রকম সামগ্রিক সারগর্ভমূলক একটা ভাষণ দেওয়া হয়েছে। যে ভাষণে আমিত্বের বদলে ‘আমরা’র কথা আছে।
ড. ইউনূসের ভাষণ লক্ষ করলে বুঝতে পারা যায়, কেন তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে সময় নিলেন। জনপ্রিয়তার সস্তা পথে না হেঁটে তিনি রাষ্ট্রের ক্ষতগুলো খুঁজে বের করে তার সরকারের করণীয় ঠিক করে নিয়েছেন। কোথায় তাঁকে কাজ করতে হবে, ঠিক কোন কোন সেক্টরে সংস্কার করতে হবে—এ বিষয়ে তিনি ও তাঁর টিম বেশ হোমওয়ার্ক করেছেন বলে মনে হলো। ফলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে তাঁর সময়ের প্রয়োজন ছিল।
তিনি যথার্থভাবেই খুঁজে বের করেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমস্যা, পুলিশ বাহিনীর অস্থিরতা, গুম–খুনসহ রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী চরিত্র, আদালত অঙ্গনের নৈরাজ্য, চিকিৎসা খাত, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, স্বাধীন সাংবাদিকতা, শিক্ষাব্যবস্থা, বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা, এমনকি জুলাই গণহত্যার শিকার শহীদদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে, সেই বিষয়েও সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল তাঁর ভাষণে।
বোঝা যায়, প্রথম ভাষণেই তিনি জাতিকে তাঁদের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছেন। তাঁরা রাষ্ট্রের কোন কোন সেক্টরে সংস্কার করবেন, তারও একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় তাঁর ভাষণে। তিনি স্পষ্ট করেছেন, সংস্কার শেষ হলেই তাঁরা অংশগ্রহণমূলক ফেয়ার একটি নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
যেই মুহূর্তে ফ্যাসিস্ট হাসিনা শাসনামলের ক্ষতগুলো দগদগে হয়ে আছে, রক্তক্ষরণ চলছে, শহীদের রক্ত এখনো তাজা, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর ভাষণ আমাদের মনে প্রশান্তি দেয়, আমাদের আশান্বিত করে। ড. মুহম্মদ ইউনুস ভাষণে যখন বলেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে এমন সব আইনের নিপীড়নমূলক ধারা সংশোধন করা হবে।’ এই বাক্য আমাদের আশ্বস্ত করে না।
আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে পাওয়া ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতার’ প্রথম প্রহরেই আমরা কতিপয় লেখক–অ্যাকটিভিস্ট আওয়াজ তুলেছিলাম, ‘তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন’ যা পরবর্তীকালে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ তৎপরবর্তী সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ সংশোধন বা সংস্কার নয়, এ ধরনের আইন বাতিল করতে হবে।
১৪ আগস্ট ডিএসএ ভিকটিম নেটওয়ার্ক জাতীয় প্রেসক্লাবে মানববন্ধন করে এ আইন বাতিলের জন্য আইন উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। স্বভাবতই আমরা আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এ আইনের সংশোধন নয়, বরং বাতিলের প্রস্তাব থাকবে। কিন্তু তা ভাষণে ছিল না।
আমরা বলতে চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে, এমন আইন আগস্ট বিপ্লব–পরবর্তী বাংলাদেশে থাকতে পারে না।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুধু ৩৬ দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়। ১৫ বছর ধরে মানুষের বাক্স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করে, মানুষের যন্ত্রণা, কান্না, চিৎকারকে দমিয়ে রাখার যত সব চেষ্টা ছিল, সবকিছুর সম্মিলিত ক্রোধের মহাবিস্ফোরণ ছিল । আর এর সবকিছুই করা হয়েছিল মূলত ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন আইনের’ মাধ্যমে।
আমরা বিশ্বাস করি, এই সরকার মতপ্রকাশকে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করবে না এবং তারা নেক নিয়তেই নিপীড়নমূলক ধারাগুলো সংশোধন করবে। কিন্তু এই সরকার তো আজীবনের সরকার নয়। তারা একদিন নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, এমন প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছে।
ফলে পরবর্তী যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা যে ‘সংশোধিত ধারা’র ভেতর থেকেই এই আইনকে ব্যবহার করে ভিন্নমতকে দমন করবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়?
এসব আইনের ফাঁকফোকরের সীমা–পরিসীমা নেই। তাই জেনে–বুঝে এ রকম একটি আইনকে আপনারা কেন জিইয়ে রাখতে চান? এ সরকারের কাছে মানুষের চাওয়া অসীম। তারা হয়তো সেগুলো আস্তে আস্তে পূরণও করবে, তবে বেশির ভাগ দাবিদাওয়ার সঙ্গে আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কিন্তু উল্লিখিত আইনের বিষয়ে আমাদের যে দাবি তা পূরণ করার করার জন্য রাষ্ট্রের একটি টাকাও খরচ হবে না।
শুধু একটু দরদ খরচ করতে হবে এই দেশের মানুষের জন্য। তাদের জবান খুলে দেওয়ার জন্য। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই চাওয়া কি আমাদের খুব বেশি?
এহসান হাবীব কবি ও আন্দোলনকর্মী