রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটো কি সত্যিই যুদ্ধ করতে প্রস্তুত?

শীতল যুদ্ধের পর ন্যাটোর সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়াটি এখন চলছে। স্টিডফাস্ট ডিফেন্ডার জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া এই মহড়াটি চলবে মে মাস পর্যন্ত।

ন্যাটোর স্থল সেনাদের ইউক্রেনে পাঠানোর বিষয়টি এখনো বাতিল করা হয়নি—সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এই মন্তব্য করেছেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে ইউরোপের ২৬টি দেশের সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের একটি সম্মেলনে আয়োজক হিসেবে মাখোঁ বলেন, ‘ইউক্রেনে স্থল সেনা পাঠানোর ব্যাপারে কোনো ঐকমত্য হয়নি। এরপর মাখোঁ বলেন, তবে কোনো সম্ভাবনা বাতিল হয়নি। রাশিয়া যাতে এই সংঘাতে জিততে না পারে, তার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।

এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের সেনাদের প্রশিক্ষিত করে তোলা এবং তাদের কাছে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করার ক্ষেত্রে ন্যাটোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর মধ্যে এই ভয় ব্যাপকভাবে আছে যে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে তাতে চূড়ান্ত মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিন এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা নিয়মিত হুমকি দিয়ে চলেছেন যে সংঘাত যদি আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাঁরা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পিছপা হবেন না।

শীতল যুদ্ধের পর ন্যাটোর সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়াটি এখন চলছে। স্টিডফাস্ট ডিফেন্ডার জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া এই মহড়াটি চলবে মে মাস পর্যন্ত। এতে ৩১টি দেশ অংশ নিচ্ছে। ন্যাটোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষা সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য এই মহড়া। এর আগে শীতল যুদ্ধের শেষ সময়ে ১৯৮৮ সালে রিফরগর মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্স ও ডেনমার্কের ১ লাখ ২৫ হাজার সেনা অংশ নিয়েছিল।

ন্যাটোর ইউরোপীয় অঞ্চলের প্রধান কমান্ডার জেনারেল খ্রিস্টোফার ক্যাভলি বলেছেন, ‘স্টিডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪ মহড়াটি আমাদের ঐক্য, শক্তি এবং একে অন্যকে রক্ষার পরিষ্কার একটা প্রদর্শনী। আমাদের মূল্যবোধ ও নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থারও প্রদর্শনী এই মহড়া।’

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সেনারাও অংশ নিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ন্যাটোর আকার ও সেনাদের নিয়োজিত করার সক্ষমতা জানান দেওয়া হচ্ছে।

শীতল যুদ্ধের সময়ে ন্যাটো নিয়মিত এ ধরনের বড় সামরিক মহড়ার আয়োজন করত। দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৮৪ সালের লায়নহার্ট মহড়ার কথা বলা যায়। যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে এই মহড়ায় ৫৭ হাজারের মতো ব্রিটিশ সেনা ও বিমান সেনা অংশ নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, পশ্চিম জার্মানির সেনা মিলে সেই মহড়ায় অংশ নিয়েছিল ১ লাখ ৩১ হাজার সেনা।

সোভিয়েত শিবিরের অবলুপ্তির পর ন্যাটো একটা নতুন আত্মপরিচয় খুঁজতে শুরু করে। ১৯৯০-এর দশকে গিয়ে ন্যাটো আগের অবস্থান পাল্টানো শুরু করে। সদস্যদেশগুলোর সাধারণ স্বার্থ রক্ষায় সাধারণ ভূখণ্ড রক্ষায় মনোনিবেশ করে ন্যাটো। ১৯৯৫ সালে বসনিয়া যুদ্ধে ও ১৯৯৯ সালে কসোভো যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেছিল ন্যাটো। এর মধ্য দিয়ে ন্যাটো আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন কৌশল নীতি অনুমোদন দিয়েছিল।

ঐক্য নাকি অনৈক্য?

এই মুহূর্তে ন্যাটোর ঐক্য ও সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, গত দুই বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধে কীভাবে সাড়া দেবে এবং কতটা অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করবে, তা নিয়ে পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে অনৈক্য চলে আসছিল।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটা মন্তব্যের পর ন্যাটোর এই মহড়া আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ট্রাম্প বলেছেন, যেসব সদস্যরাষ্ট্র সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে ন্যাটোর গাইডলাইন অনুসরণ করতে ব্যর্থ হবে, তাদের সুরক্ষা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র।

ন্যাটোর গাইডলাইন অনুসারে, সদস্যরাষ্ট্রগুলো তাদের মোট জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করতে হবে। কিন্তু বিষয়টা আরও বেশি জটিল। যেমন কিছু রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে ন্যাটোর গাইডলাইন অনুসরণ করে কমপক্ষে ২ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। আবার কিছু দেশ ২ শতাংশের নিচে প্রতিরক্ষা ব্যয় করলেও মাথাপিছু বরাদ্দ আবার ন্যাটোর গাইডলাইন থেকে বেশি।

উদাহরণ হিসেবে লুক্সেমবার্গের কথা বলা যায়। দেশটি তার প্রতিরক্ষা বাজেটের মাত্র দশমিক ৭২ শতাংশ ব্যয় করে। কিন্তু মাথাপিছু ব্যয়ের হিসাবে তারা ৯২১ মার্কিন ডলার ব্যয় করে। মাথাপিছু বরাদ্দ পোল্যান্ড কিংবা ফ্রান্সের চেয়ে বেশি।

যুক্তরাষ্ট্র তার মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করে প্রতিরক্ষায়। কিন্তু এর সবটাই ন্যাটোর বিধি মেনে বরাদ্দ নয়। যুক্তরাষ্ট্র তার বেশির ভাগ সামর্থ্যটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও দেশের ভেতরে ব্যয় করে। ফলে এই শর্তে ন্যাটোর সদস্যপদের মান নির্ণয় করা বিভ্রান্তিকর।

ন্যাটো চুক্তির প্রধান ধারা হলো উপধারা ৫। এই উপধারা অনুযায়ী ন্যাটো সম্মিলিত নিরাপত্তার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে এবং তৃতীয় কোনো বৈরী পক্ষের দ্বারা ন্যাটোর কোনো সদস্যরাষ্ট্র যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে সেই দেশটিকে রক্ষায় সদস্যরাষ্ট্রগুলো বাধ্য থাকবে।

দৃষ্টান্ত হিসেবে আফগানিস্তান যুদ্ধে এবং ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে’ ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো এর আওতায় যুদ্ধ করেছিল।  

ন্যাটো কী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত?

যাহোক, ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জন্য এখন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যাটি সৈন্য মোতায়েন নয় বরং সৈন্যদের কাছে রসদ সরবরাহ করা। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে এটা প্রমাণিত যে দীর্ঘস্থায়ী আধুনিক একটা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত থাকা দরকার কিংবা উৎপাদন করা দরকার, তার সামর্থ্য ন্যাটোর নেই।

এর কারণ হলো ন্যাটো দীর্ঘদিন ধরে যে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রয়েছে তা হলো, ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার’ যুদ্ধ। এর অর্থ হচ্ছে ন্যাটোর ততক্ষণই যুদ্ধ করার সক্ষমতা থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ থাকবে। সে কারণেই ন্যাটোর কৌশল নীতি হলো সংঘাত যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করে ফেলা।

প্রেসিডেন্ট মাখোঁর মন্তব্যের সঙ্গে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ এরই মধ্যে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক ও সুইডেন রয়েছে। তবে রাশিয়া কিন্তু মাখোঁর মন্তব্যকে ঠিকই আমলে নিয়েছে। ক্রেমলিনের মুখপত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেছেন, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পশ্চিমা সেনাদের পাঠানোবিষয়ক আলোচনাটিতে ‘খুব গুরুত্বপূর্ণ নতুন উপাদান’ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমাদের আর সম্ভাবনার বিষয়ে কথা বলার দরকার নেই, কিন্তু অনিবার্যতা (সরাসরি সংঘাত) নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন।’

  • কেনটন হোয়াইট, ইউনিভার্সিটি অব রিডিং মালয়েশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের প্রভাষক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত