‘আচ্ছা, আপনি কি এই পার্কে প্রায়ই আসেন?’
‘না। আজকে এসেছি। বাসায় বিদ্যুৎ নাই। জেনারেটর কাজ করছে না। ফ্যান চলছে না। তিষ্ঠোতে না পেরে পার্কে এসেছি। যদি একটু বাতাস পাই।’
‘আমিও তা-ই। আমিও এই পার্কে কোনো দিন আসিনি। আজ গরমের ঠেলায় চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।’
‘আচ্ছা, আমরা আলাদা মানুষ, কিন্তু আমাদের নিয়তি এক।’
‘তো বসেই যখন আছি, একটু গল্পগুজব করি।’
‘আচ্ছা।’
‘ব্ল্যাকআউট হলে বা হঠাৎ রাতের বেলায় বিদ্যুৎ চলে গেলে আমেরিকায় বা ইংল্যান্ডে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা শুনেছি।’
‘আমিও শুনেছি। নিউইয়র্কে নাকি একবার বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। অনেক নাকি ক্রাইম ঘটেছিল।’
‘তো আমাদের দেশে বিদ্যুৎ চলে গেলে লুটপাট হয় না। কেন?’
‘কারণ, সবাই স্ট্যাটাস লিখতে বসে যায়। এমনকি এই দেশে ভূমিকম্প হলেও লোকে আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করে না। শান্তভাবে আগে স্ট্যাটাস লেখে।’
‘এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?’
‘বললামই তো স্ট্যাটাস লেখে।’
‘লুটপাটের খবর তো পেলাম না। তাতে আমাদের দেশের মানুষের উন্নত চরিত্রই প্রমাণিত হয়।’
‘সাধারণ মানুষ তো ভালোই। ভালো মানুষের সংখ্যা তো বেশিই। তবে ঘটনা কী জানেন, এই দেশে লুটপাট লোডশেডিংয়ের সুযোগে বা ব্ল্যাকআউটে হতে হয় না। এই দেশে লুটপাট হয় প্রকাশ্যে দিনের বেলায়।’
‘এসব কী বলছেন আপনি! প্রকাশ্যে হবে কী করে?’
‘প্রকাশ্যে কীভাবে হয়, আমি একটা উদাহরণ দিতে পারি। আমাদের সংসদ সদস্যদের জন্য একবার শুল্কবিহীন গাড়ি দেওয়া হয়েছিল। কোনো কোনো সংসদ সদস্য দামি গাড়ি শুল্ক ছাড়া সস্তায় কিনে বড়লোকদের কাছে কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এটা হলো প্রকাশ্যে।’
‘এসব অনেক আগের ঘটনা। এসব তো আর হয় না।’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের প্লট উপহার দেওয়ার জন্য নীতিমালা বদলাচ্ছে রাজউক। আগের নিয়মে কারও স্ত্রী বা স্বামী বা সন্তান যদি রাজউকের প্লটপ্রাপ্ত হতেন, তাহলে তিনি রাজউকের প্লটের জন্য আর আবেদন করতে পারতেন না। এখন সেই নিয়ম তুলে দেওয়া হচ্ছে। এখন স্বামী/স্ত্রী, সন্তান/পিতার প্লট থাকলেও মন্ত্রী আর সংসদ সদস্যরা রাজউকের প্লট পাবেন। এটা কি প্রকাশ্য ব্যাপার নয়?’
‘আচ্ছা প্লট কথাটার মানে কী?’
‘প্লট বিশেষ্যপদ হলে অর্থ—চক্রান্ত; কুমন্ত্রণা; খণ্ড; ষড়যন্ত্র, ফাঁদ; ক্ষুদ্র জমিখণ্ড; ফালি; টুকরা; পালা; গুপ্ত চক্রান্ত; কৌশল।
ক্রিয়াপদ হলে—অঙ্কন করা; অভিসন্ধি করা; নকশা করা; খসড়া রচনা করা; ষড়যন্ত্র করা; চক্রান্ত করা; অঙ্কিত করা; কুমন্ত্রণা করা; টুকুরা; কৌশল বা ফাঁদ পাতা।’
‘আচ্ছা কিন্তু নাটকের প্লট, উপন্যাসের প্লট, সিনেমার প্লট, গল্পের প্লট বলতে একটা কথা আছে না?’
‘হ্যাঁ। আছে। ইংরেজিতে প্লটের মানে খুঁজলে ওটাই আগে আসে। নাটকের বা গল্পের বা উপন্যাসের পটভূমি।’
‘তাহলে তো নাট্যকার, লেখক, ঔপন্যাসিকদের প্লট দরকার আগে।’
‘তা দরকার। তবে সেটা তো আর রাজউকের প্লট নয়।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। রাজউকের প্লট দরকার তাহলে মন্ত্রী আর সংসদ সদস্যদের!’
‘হ্যাঁ। কারণ, তাঁরা বড়ই গরিব। জনগণের জন্য কাজ করতে করতে তাঁরা নিঃশেষ। তাঁদের আর কিছুই নাই। তাঁরা নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। এবার তাঁদেরও তো দেশবাসীর কিছু ফেরত দেওয়া চাই।’
‘জি বোঝা গেল জিনিসটা। আর ওই ডেমু ট্রেনের বিষয়টা যেন কী?’
‘এই সব আবার আলাপ করতে যাচ্ছেন কেন? ৬০০ কোটি টাকা দিয়ে ২০টি ডেমু ট্রেন কেনা হয়েছিল ২০ বছর চলবে বলে। বছর ছয়েক চলার পর আর কোনোটাই চলছে না। কেনা হয়েছিল ২০১৩ সালে। চলার কথা ২০৩৩ পর্যন্ত। ২০২২–এ এসে দেখা যাচ্ছে, তারা সবাই নট নড়ন নট চড়ন অবস্থায় এসে গেছে। মধ্যখান থেকে জনগণের আরও কিছু টাকা বেরিয়ে গেছে রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামতের কাজে।’
‘জনগণের টাকা এত সস্তা?’
‘ওই যে শুরুতেই কথাটা উঠেছিল। এই দেশে কেন ব্ল্যাকআউটে লোকে স্ট্যাটাস লিখতে বসে। কারণ, উন্নত দেশে ব্ল্যাকআউট একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিদিন ঘটে না। হঠাৎ করে বিশ–ত্রিশ বছর পর একবার ঘটতে পারে। এই দেশে এক দিন বিদ্যুৎ চলে না যাওয়াই অস্বাভাবিক। কাজেই ব্ল্যাকআউট নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নাই। তার ওপর আছে সেই কথা। দিনের আলোতেই যখন লুটপাট করা যায়, বছরে ৩৬৫ দিনই যদি লুটপাট করা যায়, তাহলে কখন কারেন্ট যাবে, এই আশায় বসে থেকে লাভ কী! আমাদের প্রতিদিনই ব্ল্যাকআউট। আমাদের প্রতিমুহূর্তই লুটপাটের মুহূর্ত।’
‘কিন্তু আমরা বলছি, দেশের বেশির ভাগ মানুষ ভালো। তাহলে ভালো মানুষেরা এটা হতে দিচ্ছে কেন?’
‘কারণ, ভালো মানুষেরা সবাই ব্যস্ত স্ট্যাটাস লিখতে। আমাদের ইস্যুর অভাব নাই। এই শাকিব খান, তো ওই পোশাকের আকার। আমাদের তো প্রতিটা ইস্যুতে মূল্যবান মত জানাতে হবে। এই দেশের চেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ এবং বড় বাক্স্বাধীনতার দেশ আর আছে নাকি? আমরা প্রতিটা ইস্যুতে স্ট্যাটাস লিখতে পারি এবং প্রত্যেকের মতের সমান মূল্য। প্রত্যেকের লাইকের সমান গুরুত্ব। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি!’
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বোধ হয় বিদ্যুৎ চলে এল। যাই বাসায় যাই।’
‘আমিও যাই। আপনাকে যা বলেছি, সেসব আবার কারও সঙ্গে শেয়ার করতে যাবেন না। আপনার মুঠোফোনে সবকিছু রেকর্ড করার ব্যবস্থা নাই তো?’
‘আছে।’
‘তাহলে আপনি কাইন্ডলি দেখুন না, ভুল করে সব কথা রেকর্ড করে ফেলেননি তো?’
‘না ভাই। সেই ভয় নাই। কারেন্ট ছিল না বলে মুঠোফোনের চার্জ গেছে চলে।’
‘তাহলে আমি নিশ্চিন্তে যাই।’
‘আপনি তো নিশ্চিন্তে গেলেন। কিন্তু আমি কী করব? আপনি যে আমার কথা রেকর্ড করেননি, তা বলব কী করে?’
‘করিনি ভাই, করিনি। আমরা হলাম জনগণ। আমরা তো দুই নম্বরি করতে পারি না। যদি দুই নম্বরিই করতে পারতাম, তাহলে কি আর পার্কে এসে হাওয়া খাই? ঠিকই আমার ঘরে আলো জ্বলত, পাখা ঘুরত। আসি। ভালো থাকবেন।’
‘বলছেন ভালো থাকতে। তো ভালো থাকার হুকুম জারি হলে তা–ও থাকতেই হবে।’
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক