কিছু রাজনৈতিক সংকট আছে, যেগুলো নিয়ে অনুমান করা কঠিন। জুন মাসের শেষে রাশিয়াতে যে রাজনৈতিক সংকট দেখা গেল, সেটা তৈরি হতে কয়েক মাস সময় লেগেছে। আপাতভাবে এ ঘটনাকে ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপের প্রধান প্রিগোশিনের সঙ্গে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংঘাত বলে মনে হলেও, এটা কীভাবে ঘটেছে, সেটা জানা বেশ কঠিন।
মস্কো অভিমুখে ‘ন্যায়ের জন্য অভিযাত্রা’র নামে প্রিগোশিনের সামরিক অভিযানটি রুশরা এবং বিশ্ববাসী দেখেছেন ২৪ জুন তারিখে। ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে হামলার মতোই অপ্রত্যাশিত, বেদনাদায়ক, ভীতিকর ঘটনা ছিল এটি। অন্য কথায়, ক্ষমতার কেন্দ্রে সশস্ত্র হামলা প্রচেষ্টার অভিজ্ঞতা রাশিয়ার ক্ষেত্রেই একমাত্র ঘটনা নয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ২০২০ সালের ঘটনা যেভাবে মোকাবিলা করেছে, সাম্প্রতিক সংকট সমাধানে ক্রেমলিন পুরোপুরি ভিন্ন পথ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, ৬ জানুয়ারির ঘটনা তারা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করেছে। এর নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার গঠিত কমিশন। শুনানিটি গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়েছে এবং ৮০০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এই হামলায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে প্রায় এক হাজার জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
রাশিয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, ভ্লাদিমির পুতিন প্রিগোশিনের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং ভাড়াটে বাহিনীর কিছু সেনাসহ তাঁকে বেলারুশে নির্বাসনে পাঠান। এ বিদ্রোহের ঘটনায় ভবিষ্যতে যদি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেটা সবার আড়ালেই ঘটবে। সুতরাং রাজনৈতিক পরিসরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটে, সেটা দেখে পরিস্থিতি আঁচ করে নিতে হবে বিশ্লেষকদের।
সামরিক বাহিনীর ওপর সমর্থন এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে আসায় এবং তাদের ওপর বিশ্বাস হারানোর ফলে ক্রেমলিন বড় ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বেসরকারি খাত ক্রমাগত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ায় সামরিক শিল্প ও সরকারি কেনাকাটায় রাশিয়ার অর্থনীতি নতুন করে সাজাতে হচ্ছে।
যা হোক, প্রিগোশিনের বিদ্রোহে দীর্ঘমেয়াদি কিছু প্রভাব এখনই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে এখন সব বাহিনীকে একক কমান্ডের অধীনে আনবে রাশিয়া। ক্রেমলিন এটা স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছে যে সমান্তরাল কাঠামোয় বাহিনী পরিচালনা করলে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া জন্ম হয় এবং তাতে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়।
আরেকজন প্রিগোশিনের জন্ম হোক, সেই ঝুঁকি এড়াতে চাইবে ক্রেমলিন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও কমান্ডের বাইরে স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো বাহিনীর অস্তিত্ব যেন না থাকে, সেটা চাইবে তারা। গত ১১ জুন রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর সব ব্যক্তিমালিকানাধীন বাহিনীকে তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন। সব বাহিনীকে একই ছাতার নিচে আনার ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রথম পদক্ষেপ।
চেচেন নেতা রমজান কাদিরভের বাহিনী এর মধ্যে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এর মানে কি কাদিরভের বাহিনীর ওপর ক্রেমলিন কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? ক্রেমলিন কর্তৃপক্ষ যদি নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে, তাহলে কাদিরভকে ঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবে। কিন্তু সেটা যদি না করে, তাহলে কাদিরভও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারেন। ক্রেমলিন এ ব্যাপারে সচেতন যে ককেশাস হচ্ছে রাশিয়ার সবচেয়ে অস্থির অঞ্চল।
প্রিগোশিনের বিদ্রোহের পর পুতিন দাগেস্তান সফরে যান। সমর্থক পরিবেষ্টিত অবস্থায় জনসমক্ষে উপস্থিত হয়ে নিজের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেন। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। তবে এ ধরনের জনসংযোগমূলক কর্মকাণ্ড পুতিনের জন্য অপ্রয়োজনীয়। কেননা, রাজনৈতিকভাবে পুতিনের কোনো দুর্বলতা নেই এবং ককেশাসের ওপর ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণ আছে—পুতিনের এই জনসংযোগ বরং বিপরীত ধারণা তৈরি করে।
এ ছাড়া ক্রেমলিন এখন লোকচক্ষুর আড়ালে অন্য দেশে অবস্থানরত ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপের কাঠামো ভেঙে দিয়ে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। ক্রেমলিন সব সশস্ত্র শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সফল হতে পারে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে প্রিগোশিনের মতো বিদ্রোহ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবে।
ক্রেমলিনের সামনে কিছু বড় ধরনের কাঠামোতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রিগোশিনের বিদ্রোহের সময় এর কতকগুলো প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো পরবর্তীকালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে এবং রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার অস্তিত্বকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এর মধ্যে প্রধান উদ্বেগটা রাশিয়ার সেনাবাহিনী নিজেই।
রাশিয়ার জনগণ ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে এই সন্দেহ বেড়েই চলেছে, তাদের সেনাবাহিনী ইউক্রেন যুদ্ধে জিততে পারবে কি না। যুদ্ধক্ষেত্রে যে রুশ বাহিনীর কার্যকর কিছু করতে পারছে না, এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ বেড়েই চলেছে। এ প্রেক্ষাপটে তাদের সামনে শুধু পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো বিকল্পই অবশেষ আছে। সেটা যুদ্ধের জন্য মোটেই গ্রহণযোগ্য কোনো পথ নয়।
এক বছর ধরে প্রিগোশিন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের অক্ষমতা এবং সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের যোগ্যতা নিয়ে বারবার করে প্রশ্ন তুলেছেন। রাশিয়ার জনগণের মধ্যেও এই বার্তা ব্যাপকভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। প্রিগ্রোশিনের ন্যায়ের জন্য অভিযানের পর প্রতি তিনজন রাশিয়ানের একজন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে শোইগুকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।
সামরিক বাহিনীর ওপর সমর্থন এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে আসায় এবং তাদের ওপর বিশ্বাস হারানোর ফলে ক্রেমলিন বড় ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বেসরকারি খাত ক্রমাগত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ায় সামরিক শিল্প ও সরকারি কেনাকাটায় রাশিয়ার অর্থনীতি নতুন করে সাজাতে হচ্ছে।
রাশিয়ার সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব নয়। সমাজের সবচেয়ে দারিদ্র্য ও নাজুক গোষ্ঠীকে এখন সামাজিক কল্যাণ তহবিল থেকে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, ততই বাজেট ঘাটতি ও রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে থাকবে। এতে সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচি বাধার মুখে পড়বে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রেমলিনের সামনে আশার কোনো জায়গা নেই। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে চাপ যেভাবে বাড়ছে, তাতে ভাঙন আর বিস্ফোরণই অনিবার্য।
গুলনাজ সারাফিদিনেভা ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, কিংস’স কলেজ লন্ডন
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত