গত মাসে কায়রোতে ইসরায়েল ও মিসরের সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বৈঠকে বসেছিলেন। রাফায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান, সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি ও গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
কয়েক দিন পর মিসরের একটি প্রতিনিধিদলও তেল আবিব সফরে যান। সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে তারা ইসরায়েলি নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেত, মোসাদ ও দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
এদিকে মিসরের একটি সরকারি সূত্র দেশটির সংবাদপত্র আল-শোরোককে বলেছে, রাফায় আগ্রাসন চালালে সেটা হবে ইসরায়েল-মিসর চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরায়েল রাফায় আগ্রাসন শুরু করলে মিসরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বৈঠক দুটিতে মিসরের প্রতিনিধিরা এই মনোভাব প্রকাশ করেছেন যে জিম্মিদের মুক্তি দিতে একটি চুক্তিতে পৌঁছতে হামাসকে চাপ দেবে তারা। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের দিক থেকে মিসরকে জানানো হয়েছে, রাফায় অভিযান শুরুর আগে চুক্তিতে পৌঁছনোর এটাই ‘শেষ সুযোগ’।
এ আলোচনার মধ্যেই মিসর নানা পথে চেষ্টা করে যাচ্ছে, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের স্রোত যেন সিনাই উপত্যকার দিকে না আসে। মিসর সরকারের জন্য ফিলিস্তিনিদের গণবাস্তুচ্যুতি প্রাথমিক উদ্বেগের কারণ। এ ছাড়া মানবিক, সামরিক ও নিরাপত্তার মতো বিষয়ও রয়েছে।
নিজস্ব অধিবাসী এবং গাজার বিভিন্ন জায়গা থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিসহ রাফা এখন ১০ লাখের বেশি মানুষের শহর। সে কারণে সেখানে অভিযানের মানে হচ্ছে, লাখ লাখ ফিলিস্তিনির মিসরের দিকে চলে আসা। বারবার এ ধরনের কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে, তার বিরোধিতা করে আসছে মিসর।
ইত্যবসরে রাফায় অভিযানের জন্য একটি অপসারণ–পরিকল্পনা করেছে। ফিলিস্তিনিদের তাঁবুগুলো অন্য জায়গায় সরানোর কথা বলছে তারা। কিন্তু এই অভিযানে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে, এই পরিকল্পনা পুরোপুরি অবাস্তব। তা ছাড়া কিছু ফিলিস্তিনি যারা উত্তর দিকে ফিরতে চেষ্টা করছে, ইসরায়েলের গণহত্যার মুখোমুখি হয়ে ও পথে পথে গণকবর দেখে, তারাও পথ পরিবর্তন করে সিনাই উপত্যকার দিকে চলে যাবে।
মিসরের হাতে এখন বিকল্প ফুরিয়ে এসেছে। ইসরায়েলের রাফা অভিযান থামাতে গেলে তাদের হাতে এখন একটাই পথ খোলা আছে। সেটা হলো হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে একটা বন্দিবিনিময় চুক্তি করানো।
এই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে মিসরের সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শত শত বিলিয়ন সহযোগিতা পেয়েছে। রাজনৈতিক–আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছে। বিভিন্ন সংকট থেকে উত্তরণের পথরেখা পেয়েছে। এ সমর্থনই জনচাপের মুখে মিসরের স্বৈরশাসকদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একই সঙ্গে আবার রাফায় সম্ভাব্য ইসরায়েলি আগ্রাসন হলে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনি যে দেশছাড়া হবে, তাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছে মিসর। হঠাৎ কিছু ঘটলে কী করতে হবে, সে পরিকল্পনা মিসর করেছে। মিসর পরিকল্পনা করেছে, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য তারা এমনভাবে শিবির স্থাপন করবে, যাতে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ও তদারক করা যায়।
এ ছাড়া আঞ্চলিক নিরাপত্তা বাড়ানো এবং উত্তর সিনাইয়ে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মতো পরিকল্পনাও তারা নিয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, রাফায় ইসরায়েলের অভিযানকে নিজেদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্ন হিসেবে দেখছে কায়রো।
সীমান্তের দুই পাশে ফিলিস্তিন ও মিসরের শহরের একই রাফা নাম, কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। ইতিহাসে দুই শহর মিলেই একসময় একটি শহর ছিল। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল সিনাই উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং সীমানা নির্ধারণের পর একটি শহর দুই দেশের দুটি শহর হয়ে যায়।
একটি আন্তর্জাতিক সীমানা রাফাকে দুটি ভাগে ভাগ করলেও মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের কিছু সদস্য ফিলিস্তিনের রাফায় থাকে আর কিছু সদস্য মিসরের রাফায় থাকে।
দুই রাফার মধ্যকার এই বাস্তবতার কারণে ফিলিস্তিনের রাফা থেকে শরণার্থীরা এলে মিসরের জন্য বিশাল বড় নিরাপত্তা–চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। কেননা, ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধ লড়াইয়ের ঘাঁটি হয়ে উঠবে সিনাই উপত্যকা।
এর আগেও, ২০০৫ ও ২০০৮ সালে ফিলিস্তিনিরা রাফায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এবারের চেয়ে তখন বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ফিলিস্তিনিরা তখন জানত, তারা আবার গাজায় ফিরে যাবে। কিন্তু এবারে ইসরায়েল তাদের বসতিকে পুরোপুরি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে পারে।
গত দশকে আমরা দেখেছি, মিসরের সেনাবাহিনী সেসব সশস্ত্র যোদ্ধার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যারা সামরিক বাহিনী, রাষ্ট্র ও বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। কিন্তু দৃশ্যপটে যদি এমন কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে, যারা ইসরায়েলকে লক্ষ্যবস্তু করছে, তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ব্যবস্থা নিলে সেটাকে দেখা হবে মিসর ইসরায়েলের নিরাপত্তা দিতে কাজ করছে। সেটা মিসর সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
অন্যদিক মিসরের ভূখণ্ড থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধারা যদি ইসরায়েলের দিকে হামলা শুরু করে, তাহলে মিসরে সরাসরি হামলার বৈধতা পেয়ে যাবে ইসরায়েল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মিসর নীরবে বসে থাকার মতো বিলাসিতা দেখাবে না। যদিও এখন পর্যন্ত মিসর চায় না এমন কোনো উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হোক, যেখানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সংঘাতে জড়িয়ে পড়া লাগে।
চার দশকের বেশি সময় আগে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি হওয়ার পর থেকে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক ও নিরাপত্তা সমন্বয়ের কাজটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশ দুটির সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই এগিয়ে চলছে। কেউ কেউ এমন যুক্তিও দেন যে ইসরায়েলের কাছে মিসরের গুরুত্বটা ওয়াশিংটনের কাছে উপসাগরীয় তেলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
এই সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে মিসরের সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শত শত বিলিয়ন সহযোগিতা পেয়েছে। রাজনৈতিক–আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছে। বিভিন্ন সংকট থেকে উত্তরণের পথরেখা পেয়েছে। এ সমর্থনই জনচাপের মুখে মিসরের স্বৈরশাসকদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাত অক্টোবরের পর থেকে মিসর শান্তিপূর্ণভাবে গাজা সংকট সমাধানের চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু সেটা মিসর সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। অনেক সময় সেসব প্রতিবাদ–বিক্ষোভ বল প্রয়োগ করে দমনও করতে হয়েছে।
সিনাই যদি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলার ঘাঁটি হয়ে ওঠে, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ নেবে।
আহমেদ আবদিন, মিসরের সাংবাদিকও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মিডলইস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনু্বাদ মনোজ দে