এক. পাশাপাশি দুটি দোকান। পণ্য কিনতে গিয়ে পড়ি নৈতিক সংকটে। কার কাছ থেকে কিনব পণ্য, মো. শহীদ (৫০) না সালমা আক্তার (৭০)। লেবু, কাঁচা মরিচ, কিছু মৌসুমি ফল ও শসা দিয়ে সাজানো দুটি দোকান। দুজনই ফুটপাতে বসেন। শহীদের পুঁজি হাজার দশেক আর সালমা আক্তারের হাজার তিনেক। ফুটপাতের এ দোকান দুটি বসে ঢাকার মোহাম্মদপুরের নবোদয় কাঁচাবাজারে।
দুই. দুজনের গল্পই আলাদা। শহীদের একটি ছেলে ও চারটি মেয়ে। ফুটফুটে একটি মেয়ে (১২) কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। দুটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসা। শহীদের পরিবার পড়েছে বড় সংকটে। এ কারণে ব্যবসায় বড় ধস নেমেছিল একবার। শক্ত হাতে শহীদ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।
তিন. সালমা আক্তার ২৪ বছর আগে স্বামী সন্তানসহ ঢাকায় এসেছিলেন। সাত মাস আগে স্বামী মারা গেছেন। এখন দুটি সন্তান থাকেন রংপুরে। তাঁরা মায়ের খোঁজখবর নেন না। সালমা আক্তারের মন্তব্য, টাকাপয়সা না থাকলে কেউ কারও খোঁজ রাখে না। বোনের সঙ্গে একটি ঘর ভাড়া করে নবোদয় কাঁচাবাজারসংলগ্ন এলাকায় থাকেন তিনি।
আঁকড়ে আছেন স্বামীর ছোট ব্যবসাটি। এটি তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। কিছুদিন আগে সালমা আক্তার স্ট্রোক করেন। অন্যের হাত ধরে দোকানে আসতে হয়। এভাবে চলছে তাঁর জীবনের চাকা।
চার. প্রতিদিন কারওয়ান বাজার থেকে শহীদ সালমা আক্তারের জন্য দোকানের কাঁচাবাজার নিয়ে আসেন। এ জন্য তিনি কোনো খরচ নেন না। এমনকি পরিবহন খরচও না। শহীদ ও সালমা আক্তার একই ধরনের পণ্য বিক্রি করেন, পাশাপাশি বসে। শহীদের মতে, এতে তাঁর ব্যবসার কোনো ক্ষতি হয় না। শহীদ আরও জানান, সালমা আক্তারের কপালে যতটুকু আছে, ততটুকু তিনি পাবেন। এটি আমার পাশে বা দূরে বসলেও পাবেন। শহীদের এ অদৃষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর নৈতিকতার মূল ভিত্তি।
নৈতিকতাহীন মানুষের ঘনবসতি আজ বাংলাদেশ। অর্থশাস্ত্রের নৈতিক দিকটির অনুশাসন শহীদ জারি রেখেছেন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া। শহীদ লেখাপড়া জানেন না। অক্ষরহীনতা শহীদকে মহান করেছে, যেমনটি করছে দেশের অসংখ্য ব্রাত্য সাধক ও গায়কদের।
শহীদের চোখের সামনে সালমা আক্তার নিঃস্ব হন। সালমার পরিবারের উত্থান-পতন তাঁর অজানা নয়। শহীদ বলেন, ‘সালমা চাচির বেঁচে থাকার বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে।’ শহীদ জানান, সালমা চাচির জন্য তিনি বিশেষ কিছু করেন না, কেবল কারওয়ান বাজার থেকে তিনি যা কেনেন, একই পণ্য ওনার জন্য একটু বেশি পরিমাণে কেনেন। খুব সকালে তা সালমা আক্তারের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
শহীদের কথা, ‘সালমা চাচির সঙ্গে প্রতিযোগিতার কিছু নেই? বাঁচার অধিকার তো সবার রয়েছে। একটু হাত বাড়ালে যদি কেউ ভালো থাকে, আমরা একটু হাত বাড়াই।’
পাঁচ. সালমা আক্তার সারা দিন টুক টুক করে লেবু, কাঁচা মরিচ বিক্রি করেন। দিন শেষে ৪০০-৫০০ টাকা তাঁর হাতে থাকে। দেশের বাড়ি রংপুরে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। রংপুরের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকায় সম্পর্কগুলো অচেনা হয়ে গেছে। এখন তিনি অনেকটা শিকড়হীন। চোখের পানি মুছতে মুছতে সালমা আক্তার জানান, শহীদের ভালোবাসার ঋণ তো শোধ করার না।
ছয়. বাজার মানে প্রতিযোগিতা, বাজার মানে মুনাফাকেন্দ্র। আজ বাজারে গরিব মানুষের প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। খাদ্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি কঠিন শাসানি দিচ্ছে গরিবদের। পাঙাশ জাতীয় মাছ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে! পাঠ্যপুস্তকে কী লেখা থাকছে, তা মূল বিষয় নয় আসল শিক্ষা দিচ্ছে বাজার।
সাত. বাজারে ভাঙা ডিমের চাহিদা বেড়েছে। বুঝতে হবে কোন পরিস্থিতিতে ভাঙা জিনিসের দাম বাড়ে! গিলা, কলিজা ও মুরগির পায়ের ক্রেতা বেড়েছে! জাতির পুষ্টিমান তলানির দিকে যাচ্ছে।
আট. জনগণের কোনো সিন্ডিকেট নেই। তারা রয়েছে বালুর দলার মতো সম্পর্কহীন। একটুতেই সম্পর্ক চ্যুতি ঘটে। এ সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল এঁটেল মাটির দলার মতো অচ্ছেদ্য ও অবিভক্ত।
জনগণ ছাড়া সবার রয়েছে ইস্পাত কঠিন নেক্সাসে। সমাজে সুশাসনের অভাব হলে সংঘপ্রিয়তা বাড়ে। সুশাসনহীন সমাজে মানুষ সম্ভাবনা নয়, সুরক্ষা খোঁজে। নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বলয়ে থাকতে চায়, জোট পাকাতে চায়।
বাজারে প্রতিদিন আমজনতার স্বাদ ও স্বপ্ন নিহত হচ্ছে। এটি অনিয়ন্ত্রিত বাজার, যা চরমভাবে অন্যায্যও বটে। এখানে উচ্চ বেতনের চাকুরে ও নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীকে পণ্য কিনতে সমান প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হয়।
নয়. খাদ্যের অধিকার মানবাধিকার, যা আজ চরমভাবে সংকুচিত হচ্ছে। নৈতিকতাবর্জিত, নিয়ন্ত্রণহীন এক বাজারের দানবীয় দেখছি। এ বাজারে প্রবেশ করা যায় কিন্তু পছন্দমতো কোনো কিছু কেনা যায় না। মানুষ বাজারে যায় উদ্যম নিয়ে আর ফেরে হতাশা নিয়ে। এ অন্যায্য বাজার আজ পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে ব্যক্তিত্বহীন করে তুলছে। কারণ, তিনি পরিবারের সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে পারছেন না। পরিবারে প্রতিদিন তার মাথা নিচু হচ্ছে।
নৈতিকতাবর্জিত ও স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়েছে বাজার। এই দুর্বিনীত ও মুনাফালোভী বাজার চাকার নিচে পড়ছে জনজীবন। বাজার আজ এক হৃদয়হীন চক্র। যারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বানাতে ব্যস্ত। মাটি, পানি, বায়ু, প্রাণ-প্রকৃতি, নদ-নদী বেচে টাকা বানাতে চায়। তারা তো বুঝতে চায় না সবকিছু শেষ হয়ে গেলে কেবল থাকবে টাকা, যা খাওয়া যাবে না?
দশ. এ দুর্দিনে শহীদ হলেন এক অনন্য শেরপা। যিনি পরার্থবোধ নিয়ে সালমা আক্তারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পাশে বসিয়েছেন সমধর্মী পণ্যের পসরা। সুবহে সাদিকে পাইকারি বাজার থেকে পণ্য এনে দিচ্ছেন। সালমা আক্তার যাতে দুটো পয়সা আয় করতে পারেন, বেঁচে থাকতে পারেন।
শহীদের কণ্ঠ কখনোই উচ্চকিত হয় না ক্রেতার বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণে। শহীদ সালমা আক্তারকে পেছনে ফেলতে চান না। মিলেমিশে ব্যবসা এগিয়ে নিতে চান। শহীদ সহায়-সম্বলহীন সালমা আক্তারের হাত ধরে আছেন। এ এক অমূল্য হাত। অমূল্য নির্ভরতার স্মারক।
নৈতিকতাহীন মানুষের ঘনবসতি আজ বাংলাদেশ। অর্থশাস্ত্রের নৈতিক দিকটির অনুশাসন শহীদ জারি রেখেছেন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া। শহীদ লেখাপড়া জানেন না। অক্ষরহীনতা শহীদকে মহান করেছে, যেমনটি করছে দেশের অসংখ্য ব্রাত্য সাধক ও গায়কদের।
বাজারে গেলে ক্রেতা হিসেবে নৈতিক সংকটে পড়ি। কার কাছ থেকে কিনব লেবু বা কাঁচা মরিচ? আমার পা চলে যায় সালমা আক্তারের দিকে আর শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় শহীদের প্রতি।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শহীদের পরার্থবোধ এ নিষ্ফলা সময়ে পাওয়া এক অনন্য পাথেয়!
খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ