গাজা যুদ্ধে সহিংসতাই সার, কোনো সমাধান নেই

অবরুদ্ধ গাজায় স্থল হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী
ছবি: রয়টার্স

হামাসের সর্বশেষ হামলা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের নজিরবিহীন সামরিক অভিযান মধ্যপ্রাচ্যের অনন্ত সহিংসতার চক্রকে আবার সক্রিয় করে তুলেছে বলে মনে হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, এই সহিংসতার চক্রকে ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে কারুরই তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব আরও ঘনীভূত হবে বলেই মনে হচ্ছে। এ অবস্থায় যদি কেউ সত্যিকার অর্থে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়, তাহলে তার অবশ্যই ইসরায়েলি ও ইসলামি মৌলবাদী সশস্ত্র যোদ্ধাদের প্রকৃত সত্যটা বুঝিয়ে বলতে হবে।

বড় হতে হতে আমরা শিখেছি, নিজেকে ভালোভাবে গড়ে তুলতে হলে নিজের অতীতকে ভালো করে জানতে হয় এবং সেগুলো খুব সতর্কভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়। কিন্তু আজকের দিনে আমরা এমন দুটি বিবদমান পক্ষ নিয়ে কথা বলছি যারা তাদের অতীত অভিজ্ঞতাকে ঠিকমতো মূল্যায়ন করতে রাজি নয়। এমনকি ভবিষ্যতে করণীয় পরিকল্পনাও তাদের নিজেদের কাছে পরিষ্কার নয়।

২০০৮, ২০১৪ এবং ২০২১ সালে হামাস যেসব হামলা চালিয়েছিল, তার চেয়ে গত ৭ অক্টোবর চালানো হামলা অনেক বেশি চৌকস ও পরিকল্পিত ছিল। পূর্ব জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে ইহুদি দখলদারির প্রতিবাদ এবং ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী থাকা ফিলিস্তিনিদের মুক্ত করার উদ্দেশেই হামাস এই হামলা চালিয়েছে বলে বলা হচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই হামলায় গাজার মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি একটুও বদল তো হয়ইনি; উল্টো হামাসের হামলায় ইসরায়েলের যত সংখ্যক লোক নিহত হয়েছে, তার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ ফিলিস্তিনি এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের শত শত বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের চলাচলে আগের চেয়ে অনেক বেশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে এবং তাদের ওপর ধরপাকড়ও বহু গুনে বেড়ে গেছে।

হামাস ৭ অক্টোবরের হামলায় ১৪০০ ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা করার পর এখন পর্যন্ত ইসরায়েল তাদের চালানো হত্যাযজ্ঞ এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করেনি। এর আগে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ হামাসকে বশীভূত করতে পারেনি, কারণ ইসরায়েল বরাবরই সমস্যার মূলে না গিয়ে শুধুমাত্র ওপরের ‘রোগলক্ষণ’ সরিয়ে হামাসকে উৎখাত করতে চেয়েছে।

ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তাদের নিজেদের নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করার নামে বহুবার যুদ্ধ জড়িয়েছে এবং তার মূল্য হিসেবে ফিলিস্তিনিদের জীবন, অধিকার ও ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চরম ডানপন্থী সরকার তাদের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ আসনে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বসিয়েছে এবং সেই ব্যক্তিরা আল আকসা থেকে শুরু করে দখলকৃত গোটা পশ্চিম তীরে অস্থিরতা উসকে দিচ্ছে।

খুবই ভ্রান্তভাবে ইসরায়েলিরা বিশ্বাস করে, অত্যন্ত মানবেতরভাবে ও উৎপীড়নের মধ্যে ক্ষীণ আশা নিয়ে বেঁচে থাকা ফিলিস্তিনিরা শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের বশ্যতা স্বীকার করে নেবে; ফিলিস্তিনিরা আর কোনো দিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, সিরিয়া ও মিসরের সংঘাত ও সেখানকার দখলদারির সর্বশেষ ইতিহাস বলে দিচ্ছে, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। নির্যাতিত হয়ে মুখ বন্ধ করে থাকা মানুষ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের অধিকারের বিষয়ে দৃশ্যত উদাসীন থাকতে পারে; কিন্তু মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তাদের মধ্যে থেকেই যায়। কোনো না কোনো সুযোগ পেলেই সেই মুক্তির অভিলাষ ফিনকি দিয়ে ছুটতে শুরু করে।

এ অবস্থায় আরব এবং ইসরায়েলি—উভয় পক্ষকেই তাদের নীতি ও পদক্ষেপগুলো কতটুকু অর্জন করতে পারবে সে সম্পর্কে সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা করতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা মনে রাখা এবং সে অনুযায়ী সামনে পা ফেলাটাই এমন একটি পথের সন্ধান দিতে পারে যা উভয় পক্ষের ভবিষ্যতের জন্য নিদেনপক্ষে কিছুটা আশার আলো দেখাতে পারে।

চলমান এই যুদ্ধে ইসরায়েলের দৃশ্যমান লক্ষ্য হলো, হামাস যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তার প্রতিশোধ নেওয়া; ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর নৃশংস প্রতিরোধ ক্ষমতা সংক্রান্ত ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা এবং গাজা থেকে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। কিন্তু ইসরায়েল এখনো ব্যাখ্যা করেনি, কীভাবে তারা সেই উদ্দেশ্য পূরণ করবে। পরবর্তী পরিস্থিতি তারা কীভাবে সামাল দেবে, সে বিষয়েও তাদের কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।

অন্যদিকে হামাস প্রতিবারই গাজা ও গাজার সাধারণ মানুষকে ইসরায়েলের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। এতে গোটা আরব ভূখণ্ডের মানুষ আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। গাজায় চালানো ধ্বংসযজ্ঞ যে শুধু আরব শহরগুলোর রাজপথেই ক্ষোভ ছড়ায় তা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ঠান্ডা মাথার মানুষেরও রক্ত গরম করে ফেলে।

দুঃখের বিষয়, অনেক শিক্ষিত ও অভিজাত আরবকেও তখন ফিলিস্তিন ইস্যুতে হামাসকে সমর্থন দিতে দেখা যায়। সম্প্রতি হামাসের সমালোচনা করায় আমাকে এমনই একজন আরব বুদ্ধিজীবীর ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে। তিনি বলছিলেন, হামাস কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, এটি একটি প্রতিরোধ আন্দোলন। তিনি বলছিলেন, ইসরায়েলিদের মধ্যে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা বেসামরিক লোক নন, তাঁরা অবৈধ বসতি স্থাপনকারী; সুতরাং এই মৃত্যু তাদের প্রাপ্য।

এই ধরনের ভাষ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার কারণে কীভাবে ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে তা সহজেই অনুমেয়।

আরও পড়ুন

ইসরায়েল যদি হামাসকে নির্মূল করতে না পারে, এমনকি হামাসের সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে ক্ষুণ্ন করতে না পারে, তাহলে ইসরায়েলের লক্ষ্য খুব কমই পূরণ হবে। গাজায় যে নজিরবিহীন ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক দশক সময় লেগে যাবে।

একইভাবে, এই হামলার মধ্য দিয়ে হামাসের ঘরে যা অর্জন হিসেবে আসবে তা হলো, স্রেফ একটি আত্মতুষ্টিমূলক শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ যার বিনিময়ে গাজার নিরপরাধ জনগণকে রক্ত, ঘরবাড়ি এবং ভবিষ্যৎকে মূল্য হিসেবে দিতে হবে।

যখনই যুদ্ধ শেষ হবে তখনই নিরীহ বেসামরিক ইসরায়েলিদের প্রতি হামাসের ঘৃণা চরমে পৌঁছে যাবে। যুদ্ধ শেষে আবারও হামাসের সমর্থকেরা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িঘর ও নিরপরাধ গাজাবাসীর মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে ‘বিজয়’ উদযাপন করবে।

এ অবস্থায় আরব এবং ইসরায়েলি—উভয় পক্ষকেই তাদের নীতি ও পদক্ষেপগুলো কতটুকু অর্জন করতে পারবে সে সম্পর্কে সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা করতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা মনে রাখা এবং সে অনুযায়ী সামনে পা ফেলাটাই এমন একটি পথের সন্ধান দিতে পারে যা উভয় পক্ষের ভবিষ্যতের জন্য নিদেনপক্ষে কিছুটা আশার আলো দেখাতে পারে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত

মুহান্নাদ আলাজ্জেহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিশেষজ্ঞ ও জর্ডানের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের সাবেক সদস্য

আরও পড়ুন