অনেক অনেক দিন আগের কথা। শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে মুক্ত রাখার চাপ বাড়ছিল। চাপ বাড়ছিল রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানাগুলো শিশুমুক্ত রাখার। এই সময় বাংলাদেশে কী কী কাজ শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তাঁর একটা তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। শর্ত ছিল এই তালিকা তৈরির সময় শিশুদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করতে হবে। আমলে নিতে হবে তাদের মতামত। সরকারকে এই কাজে টাকা আর বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করছিল জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন। তাদের পয়সায় এলাহি আয়োজন।
জেলায় জেলায় শিশুদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ঢাকায় জাতীয় সংলাপ। চোখধাঁধানো মনভোলানো তারকা হোটেলে হিমশীতল হল রুমে শিশুদের সঙ্গে সংলাপ। সারা দেশ থেকে কাজ কামাই করে তারা এসেছে ঢাকায় বা তাদের নিয়ে আসা হয়েছে। ঠান্ডায় অনেক শিশুর কাঁপুনি আসছে কিন্তু এরপরও তাদের উৎসাহ ছিল হাঁড়ি উপচানো। পেরেশান করা প্রশ্ন আসছে একের পর এক। নানান বিনোদনে ব্যস্ত রেখে চলছে একের পর এক উপস্থাপনা। একপর্যায়ে শিশুদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হলো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের খসড়া তালিকা।
মধ্যাহ্নবিরতির আগে সেটা উপস্থাপন করা হয়েছিল। পাশের ঘর থেকে খাবারের প্রাণকাড়া খুশবু আসছে। খাবারের পর একটা শর্ট ফিল্ম দেখানো হবে পরের সেশনে যাওয়ার আগে। ফিল্মের লোভনীয় ও চিত্তাকর্ষক কিছু ট্রেলার দেখিয়ে ইতিমধ্যেই তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর মন্ত্রীরা আসবেন, তাঁদের সঙ্গে গ্রুপ ছবি হবে।
এই সময় মন–দিল দিয়ে সভায় নিজেকে আটকে রাখা কঠিন। কর্মজীবী শিশুদের স্কুল ‘সুরভি’র এক প্রতিনিধি সবকিছু উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমরা কোথায়?’ শিশু গৃহকর্মীরা কেন নেই এই তালিকায়। গর্জে উঠলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক শিশু। একাত্তরের ৭ মার্চের মতো উত্তাল হলো সভাকক্ষ।
একে একে তারা বলতে থাকল, বয়সের আগেই কি আমাদের কাজে লাগানো হচ্ছে না? আমাদের দিয়ে কি সামর্থ্যের চেয়ে ভারী কাজ করানো হয় না? মর্যাদা কোথায় আমাদের? কার্পেটে বসারও হুকুম নেই। তাদের বাসি–এঁটো খাবার আমাদের খেতে হয়। মালিকের দেওয়া কোন কাজটা আমাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর নয়? সারাক্ষণই আমরা বিপজ্জনক পরিবেশে থাকি; দরজায় তালা দিয়ে তারা চলে যায়, অনেক দিন ফেরেও না। গ্যাসের চুলার পাশে রান্নাঘরে আমাদের ঘুমাতে হয়। মা–বাবার সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না।
একটা শিশু কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ছুটি দিতে হবে বলে আমাকে আমার মায়ের মরণের খবর জানায় নাই।’ আমাদের অনেকেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আর কি হলে আমাদের কাজটাকে আপনারা ঝুঁকিপূর্ণ বলবেন? লজ্জার কথা, আজও শিশু গৃহকর্মীদের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।
সম্প্রতি (১৫ মার্চ ২০২৪) জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২–এর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী দেশে রোজগার করে খেতে হয় এমন শিশুর সংখ্যা ৬,৩৮১,২৩৬। এই সংখ্যা পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি।
এই হিসাবের মধ্যে কেবল ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ধরা হয়েছে। এখানে মূলত আনুষ্ঠানিক খাতগুলোকে বিবেচনায় আনা হয়েছে। জাতিসংঘের নানান দলিলে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ১১.৩ শতাংশ শিশুকে (৫-১৭ বছর বয়সী) কাজ করে খেতে হয়। এর মধ্যে শিশুশ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বা উভয়ই আছে।
প্রকাশিত জরিপে রোজগার করে খেতে হয় বা সংসার চালাতে এমন শিশুদের তিনটি ভাগে ভাগ করা আছে—ক. শ্রমজীবী শিশু; খ. শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশু এবং গ. ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশু
শ্রমজীবী শিশু আর শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর মধ্যে ফারাক নিয়ে অনেকের মনে ধাঁধা থাকতে পারে। গৃহীত নানা দলিলে বলা হয়েছে, ‘শিশুশ্রম’ হচ্ছে এমন সব কাজ, যা শিশুদের তাদের শৈশব থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের সম্ভাবনা বা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে, মর্যাদাহানি করে এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়সের নিচে কাজ এবং বিপজ্জনক পরিবেশে শিশুকে কাজ করতে বাধ্য করা হলে সেগুলোও শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বিষয়টিকে আরও খোলাসা করতে গিয়ে বলেছে, ‘যেসব কাজ শিশুদের মানসিক শারীরিক, সামাজিক বা নৈতিকভাবে বিপজ্জনক এবং ক্ষতিকারক এবং/অথবা তাদের পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত করে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ দেয় না; স্কুল ছেড়ে বাধ্য করে, সেগুলোই শিশুশ্রম।’
দেশের উচ্চ আদালত হাইকোর্টের নির্দেশ হচ্ছে, ১২ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে গৃহকর্মে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ কথা গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালাতেও উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলেছেন, গৃহকর্মীদের একটি বড় অংশই শিশু। এর ওপর আবার এসব শিশুকে দিয়ে সামর্থ্যের চেয়ে ভারী কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বেশির ভাগ শিশু গৃহকর্মী।
দেশের আইনে ১৮ বছরে কম বয়সী মানুষদের জন্য কিছু কাজকে সিদ্ধতা দেওয়া হয়েছে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ মন্ত্রিসভা বিশেষ বিবেচনায় শিশুদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজের বয়স শিথিল করে সর্বনিম্ন ১৪ বছর নির্ধারণ করে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার সেই ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে ‘আইএলও কনভেনশন-১৩৮’ অনুসমর্থনের প্রস্তাবেও নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।
দেশের উচ্চ আদালত হাইকোর্টের নির্দেশ হচ্ছে, ১২ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে গৃহকর্মে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ কথা গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালাতেও উল্লেখ করা হয়েছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলেছেন, গৃহকর্মীদের একটি বড় অংশই শিশু। এর ওপর আবার এসব শিশুকে দিয়ে সামর্থ্যের চেয়ে ভারী কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বেশির ভাগ শিশু গৃহকর্মী। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ২০ লাখ গৃহকর্মী রয়েছেন। এর সিংহভাগই হচ্ছে শিশু।
গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক ডিডব্লিউআরএন চলতি সপ্তাহে জানিয়েছে, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গৃহকর্মে নিযুক্ত শ্রমিকের ওপর নির্যাতন, হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো প্রভৃতি ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। গৃহশ্রমিক হিসেবে যেমন তাদের রয়েছে কিছু ন্যায্য অধিকার, তেমনি রয়েছে মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার অধিকার।
দেশব্যাপী গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষায় প্রণীত “গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’ বাস্তবায়ন না হওয়া এবং গৃহশ্রমিকদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় দেশে একের পর এক গৃহশ্রমিকের মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বিচারহীনতার কারণে দোষী ব্যক্তিরা বারবার গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের সাহস পায়। যদি এসব ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে সেই ভয়ে আর কেউ গৃহশ্রমিকদের নির্যাতনের সাহস দেখাবে না।’
গৃহকর্মী সুরক্ষা আইন চেয়ে আমরা পেয়েছি ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’। বলে রাখা ভালো, এই নীতি কিন্তু নিতান্তই নীতিকথার সমাহার। আবার নীতিকথায় অনেক সাংঘর্ষিক এবং শিশুর প্রতি অন্যায় আচরণের অনেক জানালা খুলে রাখা হয়েছে। দেশের আইনে শিশুর জন্য সহনীয় এমন কাজ কেবল ১৪ বছর পূর্ণ হলে শর্ত সাপেক্ষে নিয়োগের কথা বলা হলেও কল্যাণ নীতি ২০১৫ বলছে, ‘আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করে ১২ বছরের শিশুকেও নিয়োগ দেওয়া যাবে।
মজুরির বিষয়ে বলা হয়েছে, অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়োগকর্তা যা ঠিক করবে, তা–ই হবে। অথচ দেশে ন্যূনতম মজুরির একটা বিধান আছে। মোটা দাগে একজন অদক্ষ শ্রমিকের প্রতিদিনের (আট ঘণ্টা) ন্যূনতম মজুরি হওয়ার কথা সাড়ে তিন কেজি চালের দামের সমান।
গত ২৬ মার্চ মোহাম্মদপুর বাজারে মোটা চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল প্রতি কেজি ৫২ টাকা। সেটাকে ভিত্তি হিসেবে ধরলে একজন গৃহকর্মীর মাসিক বেতন হওয়া উচিত কমপক্ষে ৫,৪৬০ টাকা। তবে এটা শুধু বিশ্রামসহ আট ঘণ্টা কাজের মজুরি। শিশু গৃহকর্মীরা প্রায় বন্দী অবস্থায় ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। বলা বাহুল্য, এসব বিশ্লেষণ কথিত ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’তে নেই।
কাগজের নীতি আর বলার জন্য বলে নীতিকথা দিয়ে শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া সদিচ্ছা প্রকাশ করে না। দরকার বিধিমালাসহ এক শক্ত পোক্ত আইন। এরও আগে দরকার শিশু গৃহকর্মীদের কাজকে বিপজ্জনক কাজ হিসেবে ঘোষণা করা। শিশুদের বর্তমান সুরক্ষিত না হলে তাদের নিয়ে ভবিষ্যতের গান গাওয়া হবে প্রতারণার নামান্তর।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক [email protected]