১৭ জুলাই থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি আদেশে বন্ধ। এর এক সপ্তাহ পার হলো। সামগ্রিক সময়ের বিচারে এক সপ্তাহ হয়তো বড় কিছু নয়। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এটা একটা বিশাল ক্ষতি। আচরণ দেখে মনে হয় না, আমাদের শিক্ষা প্রশাসনে জড়িত ব্যক্তিরা তাঁদের সিদ্ধান্তের কারণে ছাত্রছাত্রীদের লাভ-ক্ষতির হিসাবটি বোঝেন। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করি।
আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, সেখানে গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টার শুরু হয়েছে ১ জুন থেকে। ২০-২৮ জুলাই ছিল মিডটার্ম সপ্তাহ। গত শনিবার মিডটার্ম পরীক্ষা শুরু এবং সপ্তাহান্তে তা শেষ হওয়ার কথা ছিল।
আমি যেসব কোর্স পড়াই, সেগুলোর প্রশ্নপত্র তৈরি সম্পন্ন করি। পাঠদানকৃত বিষয়ে শেষ মুহূর্তের জিজ্ঞাসাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য বিশেষ অফিস সময় নির্ধারণ করে ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দিই। সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে পরীক্ষার খাতাপত্র, হাজিরা পাতা ও ইনভিজিলেটরের তালিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা আসে।
আজ বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও অন্তত এক সপ্তাহ লাগবে পরীক্ষার নতুন সময়সূচি ঘোষণা করতে। এ ছাড়া ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা কখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরবে, তারা কখন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হবে—এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে।
সেমিস্টার শেষে ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ৭ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। আগামী ৩ থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত মিডটার্ম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলেও খাতা দেখে গ্রেড দিতে দিতে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে গড়াবে। বাকি অর্ধেক কোর্সের পাঠদানের জন্য সময় থাকবে দুই সপ্তাহ। ডাবল শিফটে উৎপাদনের ক্ষতি মেটানো সম্ভব হলেও ছাত্রছাত্রীদের দ্বিগুণ পাঠ গেলানো সম্ভব নয়। যেনতেন প্রকারে কোর্স ও সেমিস্টার শেষ করায় শিক্ষার্থীদের বিশাল ক্ষতির দায় কে নেবে?
বন্ধ ইন্টারনেট
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইন্টারনেট বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত। এটা চালু থাকলেও অনলাইনে ক্লাস নেওয়া যেত। যেমনটি ক্লাস নেওয়া হয়েছিল করোনার সময়। ইন্টারনেট বন্ধের কারণ হিসেবে প্রথমে গুজব প্রচার রোধের কথা বলা হলেও পরে নাশকতার কথা বলা হয়।
ইন্টারনেট–ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ভিন্ন স্থানে প্যারালাল সার্ভার থাকার কথা, যাতে এক জায়গায় যন্ত্রপাতি বিকল হলে অন্য জায়গা থেকে কার্যক্রম শুরু করা যায়। প্যারালাল সার্ভার কি তবে নেই? তবে কি সরকারের কথিত ডিজিটালাইজেশন কেবল ফাঁকা বুলি?
ভাবা যায়, পাঁচ দিন ধরে ইন্টারনেট বন্ধ! পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এত দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট বন্ধের এমন নজির কয়টি আছে? অর্থনীতির সার্বিক ক্ষতির কথা আর না–ই বা বললাম।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বাতিক
কথায় কথায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা সরকারের একটা বাতিকে পরিণত হয়েছে। পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় সরকারদলীয় লেজুড়ভিত্তিক ছাত্রসংগঠনকে দিয়ে ডান্ডা মেরে সাধারণ ছাত্রদের ঠান্ডা করা না গেলেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা আসে। এবারও প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সরকারি ঘোষণা আসে, পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাবার স্ট্যাম্প সিন্ডিকেটগুলো সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতি অনুসমর্থন জানায়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নির্দেশ কোনো বিবেচনা ছাড়াই বাস্তবায়ন করে।
আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হলে ছাত্রদের পাঠদান, পরীক্ষা ও শিক্ষা কার্যক্রমের কী হবে, ছাত্ররা কোথায় যাবে, কোথায় খাবে, ঘুমাবে কোথায়—এমন সব সরল প্রশ্নের কোনো জবাব সরকারের বা সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে নেই। এটা তো জানার কথা, অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত বেশির ভাগ আবাসিক ছাত্রের ঢাকায় বাড়িঘর কিংবা আশ্রয় দেওয়ার মতো আত্মীয়স্বজন নেই।
তাদের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কি
স্পষ্টতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে স্তিমিত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে আমরা দেখেছি, আন্দোলন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সীমিত ছিল। সর্বোপরি এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত ছিল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণার পর আন্দোলন দাবানলের মতো ঢাকার সর্বত্র ও সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও প্রথমবারের মতো আন্দোলনে যোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক প্রাণহানি হয়। এত বিপুলসংখ্যক মেধাবী ছাত্রের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর দায় কে নেবে?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দায়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মূল দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, মূলত উপাচার্য ও প্রক্টরের। তাঁরা অনভিভাবকসুলভ আচরণ করেছেন, ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের পুলিশের নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। সরকারদলীয় বিবেচনা তাঁদের বিবেককে আচ্ছন্ন করেছে।
এ ছাড়া এর আগেও লিখেছি, উপাচার্য ও প্রক্টরের মতো উঁচু পদে এখন খাটো মানুষদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় দায় হচ্ছে পুলিশের। নিচে বিস্তারিত লিখছি।
অস্ত্র বনাম মারণাস্ত্র
আক্রান্ত হলে পুলিশের আত্মরক্ষার অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তারা বলপ্রয়োগ, গ্রেপ্তার এমনকি অস্ত্রও ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু বলপ্রয়োগ হতে হবে প্রতিপক্ষের সমানুপাতিক।
সম্প্রতি গাজা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে তাঁবু গাড়ে ও নানাবিধ আইন ভঙ্গ করে। পুলিশ তাদের, এমনকি সহানুভূতিশীল শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করে, বল প্রয়োগ করে, কিন্তু কোথাও প্রাণহানির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
চলমান আন্দোলনে প্রায় দুই শ প্রাণহানির কারণ হলো, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমানুপাতিক হারে নয়, নির্বিচার বলপ্রয়োগ করেছে। আত্মরক্ষার অস্ত্রের, ঢিলের বিপরীতে সাউন্ড গ্রেনেড, বুলেটের মতো মারণাস্ত্র ও কাপুরুষের মতো হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে। রংপুরে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের নির্মম মৃত্যু নির্বিচার বলপ্রয়োগের জ্বলন্ত উদাহরণ।
আমাদের রাজনীতিবিদেরা (আগের সরকারগুলোও ব্যতিক্রম নয়) পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এসব মারণাস্ত্র তুলে দিয়েছেন। কারণ, তাঁরা ভোটযুদ্ধ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে আগ্রহী। মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হতে হবে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে এবং কোনো অবস্থাতেই তা দেশের নিরীহ নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে না।
সামনের পথ
আবারও বলছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিন। ছাত্রছাত্রীদের পরিচিত পরিবেশে শোক পালন ও শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে দিন। শিক্ষক–সান্নিধ্যে তাদের মনে সৃষ্ট গভীর ক্ষতে প্রলেপ লাগুক।
আসুন, জাতির জীবনে এমন ঘোর অমানিশা যেন আর না আসে, সে জন্য বিবেকচালিত হয়ে সবাই মিলে কাজ করি।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ