ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘে আনা প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থেকেছে ৩০টির বেশি দেশ। পুতিনের রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতেও অস্বীকৃতি জানানো দেশের সংখ্যাও অনেক। এ দুটি ঘটনা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর জন্য অপ্রীতিকর বিস্ময়। বিশ্বে মাত্র ৪০টি দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর অর্থ হলো, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।
সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে জি-২০ সম্মেলন ঘিরে ইউক্রেনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে ভূরাজনৈতিক বিভক্তি আবার খোলাখুলিভাবে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু শেষমেশ একটা মুখ রক্ষার বিবৃতির ব্যাপারে ঐকমত্য আসে। সেই বিবৃতিতে রাশিয়ার আগ্রাসন উল্লেখ না করে ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ’ বলে উল্লেখ করা হয়।
এর মানে এই নয় যে জি-২০ সম্মেলনের সাইডলাইনে বসা দেশগুলোর সবাই রাশিয়ার আগ্রাসনকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, তেমনটা নয়। ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার প্রতি তাদের সমর্থন নেই, তা-ও নয়। জি-২০ সম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতে খুব স্পষ্ট করে কোনো দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগকে খারিজ করা হয়েছে।
বৈশ্বিক দক্ষিণ ইউক্রেন যুদ্ধকে ইউরোপীয় যুদ্ধ বলে বিবেচনা করে। এ যুদ্ধে তাদের কোনো অংশীদারত্ব নেই বলে মনে করে। যদিও এ যুদ্ধের অবধারিত ধাক্কা হিসেবে খাদ্য ও জ্বালানির নিরাপত্তাহীনতার ভুগছে দেশগুলো। এর অর্থ হলো, অন্যায্য পথে হলেও যুদ্ধ যাতে দ্রুত শেষ হয়, সেটাই চায় তারা। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তারা মূল্য চুকাতে রাজি নয়।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় গ্লোবাল টাউন হল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। গ্লোবাল নর্থের (বৈশ্বিক উত্তর) প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে একজন আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম আমি। গ্লোবাল নর্থ (বৈশ্বিক উত্তর) এবং গ্লোবাল সাউথের (বৈশ্বিক দক্ষিণ) মধ্যে ভেঙে পড়া সেতু কীভাবে পুনর্নির্মাণ করা যায়, এ বিষয়ে বিতর্ক হয়। সেই বিতর্কে আমার চোখ খুলে গেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বকে বাধ্য করেছে বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রতি তাদের যে উপেক্ষার দৃষ্টি, সেটা পাল্টাতে। ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বিরক্তিকে সামনে নিয়ে এসেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা ঔপনিবেশিক কিংবা নয়া ঔপনিবেশিক আচরণ কিংবা মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী আচরণের কারণেও হতে পারে।
সংলাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ইউরোপ ও আমেরিকার উদ্দেশে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধির কণ্ঠেও ছিল সমালোচনার সুর। আমাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘বৈশ্বিক দক্ষিণে এখন কী কারণে পশ্চিম বৃহত্তর স্বার্থ খুঁজে পাবে?’ এই প্রশ্নের আকস্মিকতা আমাকে ভাবতে বাধ্য করে। তাঁদের করা প্রশ্নটি সঠিক।
গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণ ধারণাটি হঠাৎ করেই পশ্চিমের যেকোনো জমায়েতেই খুব বেশি শোনা যাচ্ছে। দক্ষিণেও এই ধারণার ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল এবং সাবেক উপনিবেশিত দেশগুলোতে এই ধারণার প্রচলন বাড়ছেই।
এর মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর চীন ও ভারত এবং মধ্যম সারির দেশ তুরস্ক, ব্রাজিল ও সৌদি আরব এবং গরিব দেশগুলোর মধ্যে যারা নিজেদের আওয়াজ তুলে ধরতে চায়, সবাই রয়েছে। এই দেশগুলো মনে করে, পশ্চিমা ছাঁচে অথবা পশ্চিমাদের নির্ধারণ করে দেওয়া কথার বাইরে বেরিয়ে তাদের স্বাধীন আওয়াজ শোনা উচিত। তারা তাদের আওয়াজ শোনানোর জন্য সংস্থা বানাচ্ছে। সেই সংস্থার সম্প্রসারণও করছে। সম্প্রতি ব্রিকসের ক্ষেত্রে আমরা যেটা দেখলাম। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোটটিতে নতুন সদস্য হিসেবে আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অন্তর্ভুক্ত করছে।
এখন শক্তিশালী অবস্থান নিচ্ছে তারা। ইকোনমিক কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস নাইজার অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের মতো ব্যবস্থা (বাস্তবে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি) নেওয়ার কথা বলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, সেনেগাল, রিপাবলিক অব কঙ্গো, জাম্বিয়া, উগান্ডার সরকার-রাষ্ট্রপ্রধানসহ আফ্রিকান ইউনিয়নের নেতারা কিয়েভ থেকে মস্কো উড়ে গেছেন শান্তি প্রতিষ্ঠা ও শস্য রপ্তানি অব্যাহত রাখার কথা বলতে। সৌদি আরব জেদ্দায় ৪০টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধে কি নীতি হবে, তা ঠিক করার জন্য।
বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রতি পশ্চিমারা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে, এ কারণে যে বৈশ্বিক দক্ষিণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে এখন গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় গবেষক অমিতাভ আচার্য বিষয়টি সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘গরিব দক্ষিণ’-এর সঙ্গে ‘ক্ষমতাবান দক্ষিণ’-এর সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ক্ষমতাবান দক্ষিণ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবে আবির্ভূত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছে, এ বছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ৭০ শতাংশ আসবে এশিয়া থেকে। ভারত ও চীন—দুই দেশ মিলে এর অর্ধেকটা অর্জন করবে।
কূটনীতি, লেনদেনের সম্পর্ক ও বিভিন্ন সংস্থায় ‘বহুপক্ষীয়’ সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ‘ক্ষমতাশালী দক্ষিণ’ তাদের ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারতের কথা বলা যায়। চীনের নেতৃত্বে তারা ব্রিকসের সদস্য আবার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়াডেরও সদস্য (জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত)। বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্যতম নেতৃত্ব হিসেবে, জি-২০ সম্মেলনে ভারত এবার আফ্রিকান ইউনিয়নকে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। এ পদক্ষেপ নিশ্চিতভাবেই জি-২০-কে আরও বড় অন্তর্ভুক্তিমূলকতা দিয়েছে।
সৌদি আরব ব্রিকসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় অভিযোগ থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা নিরাপত্তা অংশীদারত্ব শক্তিশালী করেছে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। তুরস্ক ন্যাটোর মিত্রদেশ। এরপরও তারা রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বকে বাধ্য করেছে বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রতি তাদের যে উপেক্ষার দৃষ্টি, সেটা পাল্টাতে। ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বিরক্তিকে সামনে নিয়ে এসেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা ঔপনিবেশিক কিংবা নয়া ঔপনিবেশিক আচরণ কিংবা মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমাদের দ্বিমুখী আচরণের কারণেও হতে পারে।
নাটালি টচি ইতালিয়ান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত